ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আবদুল খালেক

ছাত্রলীগের অতীত এবং বর্তমান ॥ একটি পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২২ অক্টোবর ২০১৯

ছাত্রলীগের অতীত এবং বর্তমান ॥ একটি পর্যালোচনা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রলীগের অসামান্য অবদানের কথা এসে যায়। ছাত্রলীগ, শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক, কাউকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবার কোন পথ নেই। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের বিভাজন ঘটে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি দ্বিজাতিতত্ত্বের ফসল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তারিখে ঢাকায় এসে ঘোষণা দেন ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। দেশে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জন্ম হয় ছাত্রলীগের। জন্মলগ্নে নাম ছিল মুসলিম ছাত্রলীগ, পরবর্তীকালে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ‘ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠার মূলে রয়েছেন তৎকালীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে কিছুদিনের জন্য কারাগারেও আটক রাখা হয়। শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর লক্ষ্যেই দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৮-৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে যখন একটি প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানোর প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে ফেলে, তখন ছাত্রলীগ শেখ মুজিবের পক্ষে ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে মাঠে নামে। তারা রাজপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিছিল করেছে, স্লোগান দিয়েছে, বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। ছাত্রলীগ এই সময় যে ভূমিকা পালন করে, ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখের একটি ঘটনাকে আমরা স্মরণ করতে পারি। সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদ যখন তুঙ্গে, আন্দোলন থামানোর লক্ষ্যে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। আমি ছিলাম সহকারী প্রক্টর। শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে তাদের ওপর গুলি চালানো হবে এবং অনেক শিক্ষার্থী প্রাণ হারাবেÑ এমন একটি খবর ড. জোহার কাছে ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু করে। শিক্ষার্থীদের বিপদের কথা ভেবে ড. জোহা সেখানে ছুটে যান। তাঁর সঙ্গে আমরাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। আমরা সে দিন জীবনের সমূহ ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রদের জীবন রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলাম। তবে ড. জোহাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ঘটনাস্থলেই ড. জোহা একজন সামরিক অফিসারের গুলি এবং বেয়নেটের আঘাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। ড. জোহা প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। ড. জোহা হত্যার প্রতিবাদে দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলন এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে কারামুক্ত শেখ মুজিবকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে লাখ লাখ জনতার সামনে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অপরদিকে লৌহমানব বলে খ্যাত জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অন্যান্য ছাত্র সংগঠন থাকলেও এটি মূলত ছাত্রলীগের আন্দোলনের ফসল। জেনারেল আইয়ুবের পতনের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন আর এক সামরিক ব্যক্তি, নাম তাঁর জেনারেল ইয়াহিয়া খান। জেনারেল আইয়ুবের পতন ঘটলেও পাকিস্তানে সামরিক শাসনের পতন ঘটেনি। তবে দেশের শাসন ব্যবস্থায় কৌশলগত পরিবর্তন আসে। সেই কৌশলগত পরিবর্তনের ফসল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। নানা কারণ দেখিয়ে মওলানা ভাসানী ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জন করেন। সামরিক শাসনের মধ্যে নির্বাচনে যাওয়ার মধ্যে ছিল মারাত্মক ঝুঁকি। শেখ মুজিব নির্বাচনটিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছাত্রলীগ শেখ মুজিবের পাশে হিমালয়ের দৃঢ়তা নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অসামান্য বিজয়ের পেছনে ছাত্রলীগের অবদানকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় দেখে দিশাহারা হয়ে ওঠে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। বল প্রয়োগের মাধ্যমে সামরিক সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। কিন্তু শেখ মুজিব তখন তাঁর অবস্থানে অটল। নির্বাচনে বিপুল বিজয় তাঁকে নেতৃত্বের শীর্ষে নিয়ে গেছে। দেশের সকল মানুষ তখন শেখ মুজিবের সঙ্গে। পাশে রয়েছে ছাত্রলীগ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, সেই জনসভায় ছাত্রলীগের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ৭ মার্চের ভাষণকে ছাত্রলীগ মোটামুটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হিসেবেই বিবেচনা করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। আমাদের এখনও মনে পড়ে, ১৯৭০-৭১ সালে আ.স.ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজসহ ছাত্রলীগের চার প্রখ্যাত নেতাকে সবাই রসিকতা করে শেখ মুজিবের চার খলিফা বলে চিহ্নিত করত। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ স্নেহভাজন ছিলেন। তবে একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই, দেশ স্বাধীন হবার পরপরই বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালীন ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধুর সামনেই ছাত্রলীগের মধ্যে মারাত্মক বিভাজন শুরু হয়। একটি মুজিববাদী ছাত্রলীগ, অপরটি জাসদপন্থী ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের এই বিভাজনে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিব্রতবোধ করেন। শুধু বিভাজন নয়, ছাত্রলীগে যে পচন শুরু হয়েছিল, ১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগের ৭জন নেতা-কর্মীকে হত্যার ঘটনা তার বড় প্রমাণ। তা ছাড়া ছাত্রলীগের কথিত চার খলিফা কে কোথায় ছিটকে পড়ে গেলেন, সে থেকে তাঁরা আর উঠতে পারেননি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে নেতৃত্বের যে বিভাজন শুরু হয়, সেই বিভাজন ছাত্রলীগের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। ১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে যে বিভাজন ছিল, সে বিভাজন যেমন কমতে থাকে, তেমনি ছাত্রলীগের মধ্যে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল, সে বিভাজনও ধীরে ধীরে কমে আসে। ৮০ এবং ৯০ দশকে জেনারেল এরশাদ সরকার এবং খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যায়, ছাত্রলীগ সব সময় শেখ হাসিনার পাশে থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। তখন ছাত্রলীগকে খারাপ কাজে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি। বরং সুবিধাবাদী কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী তখন সরকারী দলে চলে যায়। ছাত্রদের চরিত্র হননের ব্যাপারে জেনারেল জিয়া অনেকাংশে দায়ী। ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন করবার প্রক্রিয়া জেনারেল জিয়ার শাসনকাল থেকেই শুরু হয়েছে। আগে এমনটি ছিল না। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ বছর ধরে যারা শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করেছে, তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিজয় অর্জন করে, সে বিজয়ের পেছনে ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অনেক অবদান আছে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করবার পর ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনকালে ছাত্রলীগ বড় রকমের কোন চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজি করেছে, এমন প্রমাণ মেলেনি। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল ফজল হক জানালেন ছাত্রলীগের একজন শীর্ষ নেতা টেন্ডার বাক্সের কাছে গিয়ে কিছু ঝামেলা করছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ডেকে টেন্ডার বাক্সের কাছ থেকে নেতাকে হটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করি। ঘটনার এখানেই শেষ। ছাত্রলীগের কোন নেতা কখনও আর টেন্ডার বাক্সের কাছে যেতে সাহস পায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের ওপর নানা অত্যাচার-নির্যাতন নেমে আসে। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রদল এবং ছাত্র শিবিরের হাতে অসংখ্য ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে প্রাণ হারাতে হয়েছে, পঙ্গু হতে হয়েছে। ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের দাপটে ছাত্রলীগের কোন ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পর্যন্ত উঠতে পারেনি। অত্যন্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে ছাত্রলীগকে টিকে থাকতে হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে যখন জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়, জেলখানা থেকে শেখ হাসিনাকে মুক্ত করবার সংগ্রামে ছাত্রলীগ অসামান্য ভূমিকা রাখে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে ছাত্রলীগের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালÑএই ৫/৬ বছরের ইতিহাস ছাত্রলীগের জন্য নেতিবাচক। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকার খবরের দিকে তাকালে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, যেখানেই নারী ধর্ষণ, সেখানেই ছাত্রলীগ। যেখানেই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মারামারি, খুনোখুনি, রাহাজানি, সেখানেই ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের চরম অধঃপতন ঘটেছে বিগত ২/৩ বছরে। ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছে, একথা আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্তু বিগত কয়েক মাসের বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, ছাত্রলীগের ছেলেরা অবৈধ পথে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ঘটনা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের হত্যাকা-। এই ঘটনা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, দেশে ছাত্র রাজনীতির আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? রাজনীতি জীবন বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। মানুষেরই রাজনীতি আছে, অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে রাজনীতি বলে কিছু নেই। ছাত্রদের মূল পরিচয় তারা মানুষ। যেখানে মানুষ আছে, সেখানে রাজনীতি থাকবে না, এমনটি হতে পারে না। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যদি কোন রকম রাজনৈতিক চেতনা না থাকে, সে মানুষ দেশ ও সমাজের কোন কাজেই লাগবে না। তবে রাজনীতির দুটো দিক আছে। সুরাজনীতি আর কুরাজনীতি। কুরাজনীতিটাকেই আমরা বলছি অপরাজনীতি। বর্তমান ছাত্র রাজনীতি কুরাজনীতি বা অপরাজনীতির খপ্পরে পড়ে গেছে। কুরাজনীতি বা অপরাজনীতির হাত থেকে ছাত্র সমাজকে কিভাবে উদ্ধার করা যায়, সে দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। ভাল ফসল পেতে হলে ফসলের ভাল পরিচর্যা প্রয়োজন। ছাত্রলীগের কাছ থেকে ভাল কিছু পেতে হলে, তাদের পরিচর্যার প্রয়োজন ছিল। যেহেতু ছাত্রলীগকে বলা হয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন, সেদিক থেকে ছাত্রলীগকে পরিচর্যার মূল দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, মহানগর, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা ছাত্রলীগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। অর্থ দিয়ে, প্রশ্রয় দিয়ে তাদেরকে বিপথগামী করেছেন, পরিচর্যা করেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বের খ্যাতি আজ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। একটি দরিদ্র দেশকে তিনি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে যাচ্ছেন। এত দুর্নীতি, এত চুরি-ডাকাতির মধ্যেও তিনি মাথা পিছু আয় বাড়িয়ে দিয়েছেন। খাদ্যের উৎপাদন কতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষ আর না খেয়ে মরে না। দেশে-বিদেশে এখন তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগ ভাল অনেক কিছু করতে পারতো। ছাত্রলীগ দাবি তুলতে পারতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন রকম দুর্নীতি চলবে না, মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়াতে হবে। গরীব-মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির হার বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ গঠন করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ রকম কোন দাবিই ছাত্রলীগের কাছ থেকে আসেনি। আজ যে ছেলে বা মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছে, সামনের দশ বছরের মধ্যে তাকে দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। সঠিক পরিচর্যা ছাড়া সোনার মানুষ গড়ে উঠবে না। প্রতিটি ছাত্র সংগঠনেরই একটি বিশ্বাসের জগত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ থাকতেই হবে। তবে আমার আজকের এ লেখাটি মূলত ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে। ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগ খারাপ কিছু করলে তার দায়ভার আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হয়। কাজেই ছাত্রলীগকে ভাল করবার দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই পালন করতে হবে। আমার ধারণা ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার দুষ্কর্মের কারণেই এমনটি ঘটেছে। আশার কথা, দেশরতœ শেখ হাসিনা বিষয়টি ধরতে পেরেছেন এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। ছাত্রলীগের সামনে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ। ছাত্রলীগের সামনে রয়েছেন সততার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সামনে রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক কিংবদন্তি নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমীর হোসেন আমু, ওবায়দুল কাদের প্রমুখ। তাঁদের সামনে রেখে পথ চললে ছাত্রলীগের পদস্খলনের কোন সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক, সেটাই আমাদের অন্তরের প্রার্থনা। লেখক : উপাচার্য নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী এবং সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×