ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ১১:৩০, ১১ অক্টোবর ২০১৯

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ। কখনও তারা হাত তুলছেন। কখনও নামাচ্ছেন। এভাবেই চলছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। পৃথিবীর আর কোন রাজধানী শহরে এমন আদি সিস্টেম চালু আছে বলে জানা নেই। ঢাকায় আছে। থাক সে কথা। বরং আরেকটি ছবির দিকে চোখ রাখা যাক। ছবিতে গাছের কাঁচা ডাল হাতে বেদম ছোটাছুটি করছেন ট্রাফিক কনস্টেবল। কখনও বাস চালকের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন। কখনও দৌড়ে ধরার চেষ্টা করছেন মোটরসাইকেল। সবার ওপর চড়াও হচ্ছেন না বটে। লাঠির ব্যবহারে খুব সতর্ক থাকছেন- এমনটিও বলা যাবে না। লম্বা সময় ধরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের অনেক সদস্যই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। তখনই ঘটে যাচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। কোন কোন ক্ষেত্রে এটি যারপরনাই অমানবিক। গাছের ডালের আঘাতে অনেক রিক্সাচালকের উরু কালো হয়ে গেছে। যাত্রীরাও এমন ঘটনার সাক্ষ্য দেবেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে এফডিসি সংলগ্ন রাস্তার মোড়ে একই ছবি দেখা হলো। শাকিল নামের এক কনস্টেবল সেখানে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় অনেক দূর চলে যাওয়ার পর একটি রিক্সাকে পেছনে আসতে বলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে পেছানোরও কোন উপায় ছিল না। এ অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় চালক কাচুমাচু ভঙ্গিতে ট্রাফিক পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরেকটু আগে কইলেই স্যার থামাইতে পারতাম...। কথা শেষ করার আগেই রিক্সাচালকের দিকে সেই গাছের ডাল হাতে তেড়ে গেলেন তিনি। ততক্ষণে দূর থেকে অনেকেই ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। অন্য একটি রিক্সায় যাত্রী ট্রাফিক পুলিশকে উদ্দেশ করে বলে ফেললেন, আপনি তো কিছুক্ষণ আগেও আপনার নির্ধারিত জায়গায় ছিলেন না। থাকলে রিক্সা আপনাকে অতিক্রম করতে যেতে পারত না। এবার ওই যাত্রীর দিকে তেড়ে গেলেন তিনি। কথার এক পর্যায়ে গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করে বসলেন। সামান্যের জন্য লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো। আইন কানুন থাকতে খোলা রাস্তায় এমন ভীতিক পরিবেশ সৃষ্টির কী কারণ? জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশ এই প্রতিবেদককে সামান্য সমীহ করেন। বলেন, এইটা আমি বুঝব। এরপর আর কথা বলার সাহস সত্যি ছিল না। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক বা গণপরিবহনের যাত্রীদের সঙ্গেও কনস্টেবলরা বিত-ায় জড়ান। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, সামান্য কারণে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা নারী ও শিশুদের চোখের সামনে বেদম লাঠি ঘোরাচ্ছেন তারা। ঢাকার রাস্তায় এ ধরনের দৃশ্য অসুন্দর শুধু নয়, ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতার ছবিটাকেই তুলে ধরছে। কেউ কি বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন? সুন্দরভাবে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। মূল আয়োজনটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও, উৎসবে যোগ দেন সব ধর্মের মানুষ। সারাদেশের মতো ঢাকায়ও অনেক ম-প তৈরি করা হয়েছিল। স্থায়ী অস্থাীয় মিলিয়ে ২৩৬টি ম-পে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। খেলার মাঠ কিংবা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তৈরি ম-প ছিল সুদৃশ্য। আলোঝলমলে। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে একটি অন্যটির থেকে ছিল আলাদা। প্রতিমা গড়ার ক্ষেত্রেও নতুন নতুন নিরীক্ষা চোখে পড়েছে। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত প্রতœ স্থাপনা, পুরনো মন্দির ও স্থায়ী প্রতিমার ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন শিল্পীরা। ঐতিহ্যবাহী একাধিক মন্দিরের মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছিল বনানী পূজাম-পে। চূড়ায় ছিল পৌরাণিক চরিত্র ঘিরে থাকা গল্পের ফিগারেটিভ উপস্থাপনা। খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ম-প ও প্রতিমা তৈরিতে ভারতের বিখ্যাত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন অজান্তা ও ইলোরার ফর্ম ব্যবহার করা হয়। কলাবাগানের ম-প এবং প্রতিমায় দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের নির্মাণশৈলী। ঢাকার সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটি ঢাকেশ্বরী। এখানে ম-প তৈরি করা হয় হিমালয়ের কৈলাশ শৃঙ্গের আদলে। সব মিলিয়ে দারুণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল ঢাকার মন্দির ও প্রতিমা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন ম-প ঘুরে ঠাকুর দেখেছেন। পূজা অর্চনা করেছেন। বাকিরা উৎসবে মেতেছিলেন। প্রতিদিন চমৎকার সেজে ঘর থেকে বের হয়েছেন তারাও। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, সন্ধ্যার আগে কাজ থেকে মুক্ত করে নিয়েছেন নিজেকে। তার পর এই ম-পে ওই ম-পে ঘুরে বেড়ানো। কোন্ ম-পে কেমন প্রতিমা গড়া হলো, কৌতূহলী চোখে দেখা। সব ধর্মাবলম্বীদের অংশগ্রহণের কারণেই ম-পগুলোতে ছিল গায়ে গা লাগা ভিড়। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে। ভিড়ের মধ্যেই চলেছে ছবি তোলা। নাড়ু খাওয়া। গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলা থেকে কপালের লাল টিপ কিংবা চিনির বাতাসা কিনে বাড়ি ফিরেছেন যারা, তাদের ধর্মীয় পরিচয় কেউ আর জানতে চাননি। বরং অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়গান হয়েছে সর্বত্র। গত বুধবার বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শারদীয় দুর্গোৎসব। এমন সুন্দর শুরু, আনন্দঘন সমাপনীর মধ্য দিয়ে মিলে মিশে থাকার চির আকাক্সক্ষার কথা পুনর্ব্যক্ত করল বাঙালী।
×