ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশ নির্ভরতা নয় ॥ নিজস্ব অর্থে দশ মেগা প্রকল্পসহ বড় কাজগুলো নিষ্পন্নে জোর দেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:৫০, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বিদেশ নির্ভরতা নয় ॥ নিজস্ব অর্থে দশ মেগা প্রকল্পসহ বড় কাজগুলো নিষ্পন্নে জোর দেয়া হচ্ছে

রহিম শেখ ॥ বিদেশী সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা আরও কমাতে চায় সরকার। দশটি মেগা প্রকল্পসহ বড় কাজগুলোর ক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ কারণে নিজস্ব উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অলস অর্থ বিনিয়োগ এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর নানা সিদ্ধান্ত এই প্রক্রিয়ারই অংশ বলে জানা গেছে। সরকার এখন ১০ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই ১০ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা আছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এজন্য সরকার স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ এসব বড় প্রকল্পে ব্যবহার করতে চায়। বর্তমানে এ ধরনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুই লাখ ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি উদ্বৃত্ত বা অলস অর্থ রয়েছে। এর মধ্য থেকে সরকার ২৫ ভাগ অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রেখে বাকি ৭৫ ভাগ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার পরিকল্পনা করেছে। এই ৭৫ ভাগ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি। এদিকে রাজস্ব আয়ের পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি সরকার চাইছে আয়ের আরও কিছু খাত বাড়াতে। এর মধ্যে দেশের জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহারের ওপর টোল আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের সুদজনিত ব্যয় কমাতে ইতোমধ্যে ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে ১০ শতাংশ উৎসে কর কার্যকর করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থমন্ত্রী বলছেন, সরকারের টাকার কোন অভাব নেই। কিন্তু সরকারের বিপুল অর্থ খরচের চাহিদা দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাজস্ব আদায়ের পরিধি বাড়ানোর দিকেই সরকারের এখন নজর দেয়া উচিত এবং সরকার সেদিকেই যাচ্ছে। দ্রুতগতিতে চলছে দেশের ১০ মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ। সরকারের এই দশ মেগা প্রকল্প হচ্ছে- পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। এই দশ মেগা প্রকল্পের বাইরেও ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থায়ন সমস্যা নয়। প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। নির্ধারিত সময়ে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নই সরকারের মূল লক্ষ্য। দ্রুতগতিতে চলছে এসব প্রকল্পের কাজ। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পগুলো শেষ হবে। দেশের ১০ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা আছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা আছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। যারা কর দেন তাদের ওপর করের বোঝা না বাড়িয়ে যারা কর প্রদান করছেন না বা করের আওতার বাইরে আছেন তাদের করজালে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যদিও বর্তমানে দেশে মাত্র ১৫ লাখ লোক নিয়মিত প্রত্যক্ষ কর দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূইয়া জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে মোট রাজস্ব আয়ের ৩৫ শতাংশ আসে আয়কর থেকে। এটি ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ের কর অঞ্চলের সংখ্যা ৩১ থেকে বাড়িয়ে ৬৩ তে উন্নীত করা হবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের ৪ কোটি লোককে করের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে চলতি বাজেটে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের দুই মাসে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে সরকার। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের বিপুল অর্থ খরচের চাহিদা আছে। কিন্তু সরকার এখন আয় করার কঠিন পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটার চেষ্টা করছে। রাজস্ব আদায়ের পরিধি বাড়ানোর দিকেই সরকারের এখন নজর দেয়া উচিত। তা না করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে টাকা নেয়া সমীচীন হবে না। এ বিষয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নিজ কার্যালয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে টাকা পর্যাপ্ত থাকার নির্ধারিত বেঞ্চ মার্কের ওপরে এখনও ৯২ হাজার কোটি টাকা বেশি আছে। ফলে সরকারের টাকার কোনো অভাব নেই। জানা যায়, গত ১০ বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা. যা মোট বাজেটের ২৮ শতাংশই খরচ হয় বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে। আরেকটি বড় খাত হচ্ছে সুদ পরিশোধ, প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ। সরকার প্রতিবছর ঋণ করে ঘাটতি মেটাচ্ছে। আর এ ঋণের বড় অংশই আসছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্রের মতো অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। তবে এবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার না কমিয়ে ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে ১০ শতাংশ উৎসে কর কার্যকর করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে সুদ পরিশোধ ব্যয়সীমা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া মহাসড়ক থেকে টোল আদায় করে অর্থের যোগান দিতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে দেশের জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহারের ওপর টোল আদায়ের নির্দেশ দেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত সপ্তাহে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দেশের মহাসড়কে টোল আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পর এখান থেকে সরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। চারটি মহাসড়কে টোল আরোপের বিষয়ে প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি। এরপরও যাতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ সঙ্কট না হয় সেজন্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহার করতে চায় সরকার। বর্তমানে এ ধরনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুই লাখ ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি উদ্বৃত্ত বা অলস অর্থ রয়েছে। এর মধ্য থেকে সরকার ২৫ ভাগ অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রেখে বাকি ৭৫ ভাগ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার পরিকল্পনা করেছে। এই ৭৫ ভাগ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি। সরকারের পক্ষ থেকে মনে করা হচ্ছে, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিলে সে ক্ষেত্রে সুদ গুনতে হয় ৭ শতাংশ। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে নিতে হলে ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদ দিতে হয়। আর বিদেশী ঋণে সুদের হার কম থাকলেও এ ক্ষেত্রে নানাবিধ শর্তের কারণে সেই ঋণ গ্রহণটা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। এখন এই উদ্বৃত্ত অর্থের জন্য সরকারকে ‘এক পয়সা’ও সুদ দিতে হবে না। এটি নিজের অর্থের মতো ইচ্ছেমতো ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ জমা পড়ে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত মে মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী অলসভাবে পড়ে থাকা এ টাকার পরিমাণ ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফিন্যান্সিয়াল কর্পোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থার তহবিল তাদের নিজস্ব আইন ও বিধি দিয়ে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর পরও তাদের তহবিলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এসব সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ গত এক বছরে ৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা বেড়েছে। সংস্থাগুলো উদ্বৃত্ত আয় সরকারী খাতে জমা না দিয়ে নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে জমা রাখছে। স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে এসব অর্থের সঠিক ব্যবহার না করে অপচয় বা বিলাসী খাতে ব্যয় করা হয়। স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষ ২৫ প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা আছে ১ লাখ ২ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি টাকা রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের কাছেÑ ২১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার কাছে রয়েছে ১৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের কাছে আছে ১৩ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অলস অর্থ ৯ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কাছে অলস অর্থ পড়ে আছে ৯ হাজার ৫০ কোটি টাকা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিমাণ ৪ হাজার ৩০ কোটি টাকা। বিসিআইসির কাছে আছে ৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। সার, কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের আছে ৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অব্যবহৃত অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের ২ হাজার ৮০ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নেয়ার সিদ্ধান্তটি অর্থনীতির জন্য খুব ইতিবাচক। এসব প্রতিষ্ঠান তো সরকারেরই। এই উদ্যোগ কার্যকর হলে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা পাওয়া যাবে, যা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সমান। সরকার এখন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এগুলো বাস্তবায়নে এ অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এই অর্থ ব্যবহারে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কট বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বেসরকারী, বিশেষত নতুন ব্যাংকগুলো সরকারের আমানতের ওপর নির্ভর করেই চলছে। এই অর্থ উঠিয়ে নেয়া হলে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। বিষয়টি আরও ভেবে দেখা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
×