ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিপুল শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা

মেশিনারিজ ঘোষণায় জাহাজভর্তি মদ আসায় তোলপাড়

প্রকাশিত: ১০:১০, ২৬ জুলাই ২০১৯

 মেশিনারিজ ঘোষণায় জাহাজভর্তি মদ আসায় তোলপাড়

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মিথ্যা ঘোষণায় চীনের তৈরি মদ আমদানির নেপথ্যে বিপুল অঙ্কের শুল্ক ফাঁকির চেষ্টার বিষয়টি জড়িত বলেই গত দুদিনের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। তবে প্রকৃত চিত্র উদ্ঘাটনে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে পুরো জাহাজের পণ্যের কায়িক পরীক্ষার পাশাপাশি তদন্ত কাজও শুরু করেছে। উল্লেখ্য, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণায় চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে মদের বিশাল একটি চালান। খালাসকালে গত মঙ্গলবার বিকেলে এ ঘটনা ফাঁস হয়। এরপরই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নামে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে। ইতোমধ্যে চালানটির কায়িক পরীক্ষা শুরু করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে চালানের শতভাগ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে কী পরিমাণ মাদক এসেছে। মাদক বহনকারী পানামার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি কিউ জি শান জাহাজটির চট্টগ্রাম ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে। এদিকে, চালানের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড হওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। মেশিনারিজ ঘোষণায় এই প্রতিষ্ঠানের ইতিপূর্বে আমদানি করা চালানেও ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য ছিল কি না তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাখ্যা চাইবে এবং এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। কাস্টম সূত্রে জানা যায়, জাহাজ থেকে দুটি বার্জে যে কার্টনগুলো আগেই খালাস নেয়া হয়েছে সেগুলো জব্দ করা হয়েছে। তৃতীয় লাইটার জাহাজে কার্টন নামানোর সময় আটকানো হয় এই চালান। কাস্টমস কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে দেখতে পান তিন নম্বর লাইটার জাহাজটির ১৯ কার্টনের মধ্যে ১৮টিতেই মদ, বিয়ার ও নুডলসসহ কয়েক ধরনের খাদ্য সামগ্রী। বড় জাহাজ থেকে সকল পণ্য নামিয়ে শতভাগ পরীক্ষা শেষ করতে তিন-চারদিন লেগে যেতে পারে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম বৃহস্পতিবার জানান, এ বিষয়ে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা জাহাজের সমুদয় পণ্য নামিয়ে এনে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করবেন। তারপর জানা যাবে জাহাজে ঘোষণাবহির্ভূত কী পরিমাণ পণ্য রয়েছে। পরীক্ষার আগে বলা সম্ভব নয় আমদানি চালানের মধ্যে মাদকদ্রব্যের পরিমাণ। কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘোষণা অনুযায়ী ৬৬৯ কার্টনে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আসার কথা। ৮টি বিল অব এন্ট্রিতে এসেছে এই পণ্য। সেই হিসেবে একই জাহাজে চালানও আটটি। বিল অব এন্ট্রির কোথাও মদ বা বিয়ারের উল্লেখ ছিল না। পানামার পতাকাবাহী জাহাজটি গত মঙ্গলবার বিকেলে বন্দর ৩ নম্বর বার্থের ওভারসাইটে (কর্ণফুলী নদীর দিকে) নোঙ্গর করা হয়। সেখানে একটি বার্জে কার্টন নামানো হচ্ছিল। কিন্তু গোয়েন্দা সূত্রে সেখানে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য রয়েছে এমন তথ্য মেলায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এর খালাস বন্ধ করে দেয়। খবর পেয়ে গত বুধবার কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মাদার ভেসেলটি পরিদর্শন করেন। জাহাজটি বর্তমানে আটকাবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডেট নামে চালানগুলো আমদানি হয়েছে। এটি পায়রা এলাকায় বাস্তবায়নাধীন একটি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র। সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে বাস্তবায়নাধীন একটি প্রতিষ্ঠান কেন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণায় মদ ও বিয়ার আমদানি করল সে প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটি এর আগেও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণায় আরও চালান আমদানি করেছে। সে চালানগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, চীনা নাগরিকসহ বিদেশী নাগরিকদের জন্য মদ আমদানি নিষিদ্ধ নয়। প্রচলিত শুল্ক হারের তুলনায় তাদের জন্য রেয়াত সুবিধাও রয়েছে। অনুমতি নিয়ে তারা আমদানি করতে পারতেন। তা না করে এভাবে কেন আনা হলো সে বিষয়ে আমরা ব্যাখ্যা চাইব। তাদের জবাবের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চীনের সাংহাই থেকে আসা এ চালানগুলো খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের নাম বিপাশা ইন্টারন্যাশনাল। এগুলো খালাস ও পরিবহনের দায়িত্বে এএমএমএস লজিস্টিক। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই একই মালিক। চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ এলাকার লোকমান টাওয়ারে অফিস। এর আগেও বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির আমদানি করা চালান খালাস ও পরিবহনের দায়িত্ব পালন করেছিল এ প্রতিষ্ঠান। পায়রা এলাকায় পরিবহনের সুবিধার্থে পণ্যগুলো ওভারসাইটে খালাস করা হচ্ছিল বলে যুক্তি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের। প্রসঙ্গত, ৪২৬ ফুট লম্বা ও ৮ দশমিক ২ মিটার ড্রাফটের এ জাহাজটি ভিড়েছিল বন্দর ৩ নম্বর জেটিতে। কাস্টমস সূত্র জানায়, সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মেশিনারিজ হিসেবে চীন থেকে পণ্যগুলো আমদানি করা হয়। ছাড়পত্র দেয়ার পূর্বে চালানের শতভাগ পরীক্ষা সম্ভব হয় না। পুরো চালানের যাচাইবাছাই করার সুযোগ কম। তাছাড়া চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার। কিন্তু খালাস পর্যায়ে পাওয়া গেল বিপুল পরিমাণ মদ, যা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির শুল্ক মাত্র ১ শতাংশ। অপরদিকে, মদ আমদানির শুল্ক ৩৯৬ শতাংশ। বিয়ারের শুল্ক মানভেদে ২৯৩ শতাংশ থেকে ৪৪৮ শতাংশ পর্যন্ত। চালানটি যদি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খালাস নিতে সক্ষম হতো তাহলে সরকারের বড় ধরনের রাজস্ব ক্ষতি হতো। এদিকে, চীন থেকে আসা জাহাজটির ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আটক প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিপাশা ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওই জাহাজে অন্য প্রতিষ্ঠানের আরও মালামাল ছিল। বিদ্যুত খাতে অগ্রাধিকারের জন্য কাস্টমসের শুল্ক আইনের ৭৮ ধারা অনুযায়ী জাহাজের এজেন্ট স্টিম শিপ কোম্পানি বন্দরের ৩ নম্বর জেটিতে অবস্থানরত জাহাজ থেকে রিভারসাইটের তিনটি বার্জে পণ্য খালাস শুরু করে। রিভার সাইট হলেও বার্জগুলো কাস্টমস কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও তত্ত্বাবধানেই থাকে। পায়রা এলাকায় নেয়ার জন্য নদী ও সাগর পথ ছাড়া বিকল্প নেই। যেহেতু এসব মালামালের আমদানিকারক সরকারী প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে বিপাশা ইন্টারন্যাশনালের দায়-দায়িত্ব নেই। চালানগুলো সরেজমিনে কায়িক পরীক্ষা আবশ্যক। সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে কাস্টমসকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে।
×