ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ৩ বছর পূর্তি আজ

প্রকাশিত: ১০:০৪, ১ জুলাই ২০১৯

 হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার  ৩ বছর  পূর্তি আজ

শংকর কুমার দে ॥ দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে স্মরণকালের ভয়াবহ জঙ্গী হামলার আজ সোমবার তৃতীয় বর্ষপূর্তি। তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলা চালিয়ে ১৮ বিদেশী নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করেছিল জঙ্গীরা। ভয়াবহ সেই জঙ্গী হামলার ঘটনার মামলায় জঙ্গীদের বিরুদ্ধে চার্জশীট প্রদান করা হয়েছে। তিন বছর পূর্ণ হলেও আজও বিচার হয়নি। এ মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। ভয়াবহ এ হামলায় নব্য জেএমবির ২১ জন জঙ্গীর জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ আদালতে গত ২৩ জুলাই এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে পাঁচজন ওইদিন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আটজন পরে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। জীবিত আটজনের মধ্যে ছয়জন গ্রেফতার আছেন। বাকি দু’জন পলাতক। এ ছাড়া ওই ঘটনায় ৭৫টি আলামত পাওয়া গেছে। এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ। ফলে তাকে মামলার অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে, সরকারকে কোণঠাসা করতে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করতে ও বিদেশী ক্রেতাদের ফিরে যেতে বাধ্য করতে হলি আর্টিজানে হামলা চালানো হয়। এখানে সরাসরি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে জঙ্গীদের এই হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্য ছিল। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী থেকে প্রযুক্তিগত সুবিধা পেতে তারা হামলা চালিয়েছিল। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে জঙ্গীরা হামলা চালায়। তারা অস্ত্রের মুখে দেশী-বিদেশী অতিথিদের জিম্মি করে। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গীসহ ছয়জন নিহত হয়। পরে পুলিশ ১৮ বিদেশীসহ ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একজন। গুলশানের এই ভয়াবহ হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন জঙ্গী নেতা রাজীব গান্ধী, সোহেল মাহফুজ, রকিবুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান। কোথায় বসে হামলার পরিকল্পনা হয়, কারা হামলায় অংশ নেয়, কীভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়, অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে কারা ছিল এসব প্রশ্নের উত্তর জঙ্গীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে উঠে এসেছে। তবে হামলায় জড়িত শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন পলাতক আছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, চার মাস ধরে গুলশানে এই হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল জঙ্গীরা। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বেছে নেয় তারা। হামলাকারীরা তাদের লক্ষ্যস্থল সম্পর্কে জানতে পারেন হামলার মাত্র তিন থেকে চারদিন আগে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নব্য জেএমবির নেতারা ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় বিদেশীদের ওপর বড়সড় হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। হামলা করার জন্য ওই বছরের ২৮ জুন নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী বিদেশ থেকে হু-ির মাধ্যমে টাকা আনেন। হু-ি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে নব্য জেএমবির আরেক নেতা বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট তামিমের কাছে পৌঁছে দেন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়েছিল পাঁচ জঙ্গী। তাৎক্ষিণকভাবে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে নিহত হন ডিবির সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন। জঙ্গীদের হামলায় ইতালির ৯ নাগরিক, জাপানের ৭ নাগরিক, ভারতের ১ জন এবং বাংলাদেশের ৩ নাগরিককে হত্যা করে। পরদিন সকালে প্যারাকমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গীসহ ছয়জন। হামলার ঘটনায় গুলশান থানায় এসআই রিপন কুমার দাস বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আলামত হিসেবে জব্দ দেখানো হয় ১টি সাদা কাপড়ের রুমাল, ৫টি নাইন এমএম পিস্তল, তিনটি একে ২২ মেশিনগান, ১৩টি ম্যাগাজিন, নাইন এমএম ক্যালিবারের ৬টি তাজা গুলি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সফাইভ ক্যালিবারের ২৮টি গুলি, একে-২২ এর ৩৫টি গুলি, পয়েন্ট টুটু বোরের ৪৪টি গুলি, ৬ পয়েন্ট ১৬ ক্যালিবারের ১২টি গুলি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সটু ক্যালিবারের দুইটি গুলি, একই ক্যালিবারের ১৯৫টি গুলির খোসা, নাইন এমএম ক্যালিবারের গুলির ১০৫টি খোসা, নয়টি গ্রেনেড সেফটি পিন, দুটি ছোরা, একটি চাপাতি ও একটি চাকু। মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গী হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন বা চার্জশীট (অভিযোগপত্র) চূড়ান্ত করা হয়েছে। আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ও সাক্ষীদের জবানবন্দী থেকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আদ্যোপান্ত জানতে পেরেছে সিটিটিসি। ওই হামলায় তামিম ও সরোয়ার জাহান মানিকসহ ২২ জঙ্গীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে সিটিটিসি ইউনিট। এই ২২ জনের মধ্যে ১৩ জন নিহত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে। হামলার পর প্যারা কমান্ডোদের অপারেশন থান্ডারবোল্টে নিহত হয় রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামীহ মোবাশ্বীর, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে অভিযানে নিহত হন আবু রায়হান তারেক। ওই বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অভিযানে নিহত হয় তামিম আহমেদ চৌধুরী। পরে রাজধানীর রূপনগরে মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম, আজিমপুরে তানভীর কাদেরী, আশুলিয়ায় সরোয়ার জাহান মানিক, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে নূরুল ইসলাম মারজান নিহত হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে অভিযানে নিহত হয় বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান।
×