ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ২৮ জুন ২০১৯

কবিতা

* মরে গেছি বলে ফারুক আফিনদী একটা ধঞ্চের ক্ষেতে ডালে ডালে দুলতে থাকা কালো আর নীল পাখিদের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকি, বর্ষার বাতাসে উদাম বুকে, সকালে সূর্যের সঙ্গে- এভাবে শৈশব তৈরি করি-, আমি। যখন ক্রমশ লম্বা ছায়া নিয়ে আসবে দিন, ওই ধূসরতা দেখব বলে। আর হারানোর গল্পের সঙ্গে দোয়েল ও শালিকের ‘এইটুকু শান্তি’র কথা বলব বলে। একটা ধঞ্চের, কিংবা পাটের অথবা ধানক্ষেতে নিরীহ দোয়েল প্রিয় শালিখ এবং হলুদ মাখা ঘোমটায় বাবুই পাখির কাঁচাসোনা ধান খাওয়া কিংবা থেকে থেকে ওড়ার দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকি। যখন মরে যাব, বসে বসে জীবন দেখব বলে। আমি শৈশব আর জীবনকে খুব করে খুঁজি। মরে গেছি বলে। * পলাশী রহমান মুজিব অবজ্ঞার কাকতাড়ুয়া বলেই আমি স্মৃতিচাষ করি সূর্যোদয়হীন মেঘপাড়ার নিমতেতো ভোরে আজও মাপি পলাশীর অন্ধকার অথচ চোখ এবং বৃষ্টির সন্ধিখেলায় এখনো ঘুরছে কোম্পানির চাকা, হিমসুরে সিরাজের চোখ হতে গলে গলে পড়ছে বরফকল। এই চোরাই জলপথে লুৎফা যদিও ইতিহাসের অন্তিম ঝিলিক তবু ক্যালেন্ডারে তেইশে জুন বলে কোনদিন নেই, ছিল না কেননা মীরজাফরের হাসি সেতো ফোর্ট উইলিয়াম রাত্রি ঐ দেখো-স্বাধীনতা ডুবলো, রক্তাক্ত হলো আলীবর্দির নাতি। * ফ্ল্যাশব্যাক মনজুর রহমান ক্রমধাবমান সময় দেয়ালকাঁটায় স্থির হয়ে গেলে রৌদ্রতারে ঝুলে থাকা স্থির চিত্রে সময়ের জলদাগ ফ্ল্যাশব্যাকে চলচ্ছবি হয়ে যায় জানালার কাচে। সময়ের ধূসর ঠোঙা ছিঁড়ে রঙিন মার্বেলগুলো মৃতস্বপ্নের হাহাকারধ্বনি তুলে ক্রমশ ক্ষীয়মান হয়ে যায়- বিস্মৃতি প্রবণ সময় গড়ায়... * তোমার নামে আবু সালেহ মোঃ ইউসুফ এই কবিতা মধ্যরাতে লিখছি তোমার নামে বকুল ফুলের গন্ধ দিলাম শুভ্র মেঘের খামে। কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ পাঠালাম দখিন হাওয়ার পীঠে গাঙশালিকের গান শুনিও মন হলে খিটখিটে। পাখির ঠোঁটে ভোর পাঠালাম ফুলের পরাগ ঘাসও ঘুঘুর ডাকে চমকে উঠে ফুলের মতো হাসো। কিনতে তোমার মুক্তা ঝরা হাসিটা খিলখিল পানির দামে অনায়াসে বেচবো চলন বিল। একটুখানি ছুঁতে তোমার নীল গোলাপি টিপ দেবো লিখে ভিক্টোরিয়া-সেন্টমার্টিন দ্বীপ। তুমিহীনা ফুল ফোটে না চাঁদ নীলিমা ফিকে তোমার নামে দেবো উদার আকাশখানি লিখে। নীলে ঠাসা বন হরিণীর করতে দু’চোখ পাঠ দলিল করে দেবো নদী শিশির ভেজা মাঠ। নির্বাসনে পাঠিয়ে তব ধরার সকল ফুল * সাঁকোর বংশীবাদক তুলি রহমান এখন দহনবেলা। নাচে নাগ। ভেঙে পড়ে সাঁকো বিমুক্ত বন্ধনে সাঁকোর ছায়ায় ঘুমায় বংশীবাদক। এখন দহনবেলা। নাচে নাগ। আত্মার দুরাগমন খোলসে আবৃত মুখস্থ জীবন। গতিবিদ্যার ত্বরণে মুদ্রাজীবন আয়ত্তকরণ। এখন কালিন্দীজলে কাপালিক জন্মের আত্মগোপন। খুব গোপনে তারার পতনে পাখি জন্মের ভয়। ভয়-ভয় ক্রীড়ায় অর্ধচেতন মমতা পেন্ডুলাম নির্বাহক। নাগবীণে বাজে নির্মোহ সুর। ভেঙে পড়ে সাঁকো। সাঁকোর বংশীবাদক ঘুমাচ্ছন্ন। চাঁপা হয়ে আঁকড়ে রবো তোমার কালো চুল। ভুল করেও খোঁপাখানা খোলো না অপ্সরা তলিয়ে যাবে অন্ধকারে আলোর বসুন্ধরা। * এর চেয়ে বড় কোন কষ্ট নেই এসএম সেবুল মনে করো সমুদ্রে আমার জাহাজ ডুবে গেছে বার বার হন্তারকের ছুরিকার নিচে কেমন লাগে সে আমার দেখা সাজানো বাগান তছনছ হলে কতটা কষ্ট লাগে তাও জানি সবকিছু মেনে নিতে পারি তোমার অন্তর্ধান পারি না তুমি না থাকার কারণে হল্লা করে নেমেছে বিষাদ। আজও আমি দুর্মর তোমারই ধ্যানে মগ্ন বিভোর দুর্বিনীত সময়ের উপেক্ষা আমি কার কাছে রাখি? মনে করো দিন গেছে দিনেরই নিয়মে এলোমেলো ছত্রখান কেউ দেখেনি সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখা নিরেট দহন নিরানন্দ জীবনে তুমি ছাড়া আর কোন প্রবৃত্তি নেই। মনে করো আমি একদম নিঃস্ব হয়ে গেছি নির্দ্বিধায় মেনে নিতে পারি ভিখিরি জীবন যদি বাস্তব হয় আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি ঈশ্বর সহিষ্ণু হলে আমার আর কোন কষ্ট থাকে না। কন্টকাকীর্ণ পথে তুমিহীন আমি আজ একা এর চেয়ে বড় কোন কষ্ট নেই পারু এর চেয়ে বড় কোন দুঃখ আমি পুষি না হৃদয়ে তুমি ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন অসার ইচ্ছা বিরুদ্ধ নির্মম বেঁচে থাকা আমার নিয়তি। * অবাক অবেলায় মির্জা সাব্বির হোসেন বেগ আর কত দুঃখ পেলে বলোহে’ মহাকাল এ ক্লান্ত-বুভুক্ষ হৃদয় তবু পাবে ক্ষমা, অনেক পথ তো আমি হেঁটেছি এতকাল! আলোর পরে সে একাই আঁধার-উপমা। বহুকাল জন্মেছি আমি, দেখিনি ব্যতিক্রম, গলি থেকে রাজ পথে, আরও দূর পথে চিরকাল ফিরে আসে সে অদৃষ্ট আঁধার ভ্রম, আরও দূর পৃথিবীতে, আরও অদেখাতে। তবু বসন্ত এলে দেখি যে কত রুদ্রাক্ষের ফুল, আর শ্রাবণ দিনে হায়! আজও সে ঝরা পাতা। আজ কেন তবে বৃষ্টি দেখে হয় হৃদয় আকুল! আমি তো গাইনি সে গান, লিখিনি সে কবিতা। একদিন জানি তবু যাবো চলে, যাবার সময়; মর্ত্যরে সব কীটপতঙ্গ হবে আমার সঙ্গী, নীরব আঁধারে তাদের খাদ্য হবে এ হৃদয়, এক আঁধার থেকে হবো আরেক আঁধারে বন্দী। সে আঁধারের এপারে আজ আমি লিখছি এ লেখা; অনেক রাতের পর যে আঁধার তবু চির অদেখা। (২৫ ভাদ্র, ১৪১৭) * ঔপনিবেশিক শিশুকাল বাদল আশরাফ একটু দাঁড়াও লাবণ্য এই সুরম্য ভবন যে ভূমিতে গরবে দ-ায়মান সেখানে দেখেছি শৈশবে এক মৌসুমি জলাশয় বিষ কাটালির বন বিরাট এক ডুমুরের ছায়া ঘিরে অগণিত ধুতরার শাখা আর স্যাঁতর্সেতে ব্যাঙের ছত্রাক! দিনের বেলাতেও সেদিকে একাকী যেতাম মনে পড়ে না কখনো, তবে একদিন তর্কালঙ্কার উত্তীর্ণ দিদির অনামিকা ধরে পাঠশালা যাবার পথে লাল গিরগিটি আমায় করেছে ভীষণ তাড়া। বর্ষায় ওখানে সুখের আশ্রয় আর স্বর্গের সিঁড়ি হতো মাছ, ব্যাঙ ঢোড়া সাপ এবং রক্তলোভী জলৌকা সকলের। আমি খুব বাধ্য ছেলের মত দেখেছি সাথীরা দূর্বিনীত উল্লাসে আমার আতঙ্কের আশ্রয় দলে ধরে আনে যেই এক রাখাল সজারু অমনি খ্যাতিমান দূতের মত দিয়েছি হরিণছুট সাথে তারস্বরে চিৎকার- দিদি, তাড়াতাড়ি আয় দেখে যা! একদিন আমিও তর্কালঙ্কার উত্তীর্ণ হই বৃষ্টিতে জমে ওঠা পথজলে ডোবে না হাঁটু জলাশয়টাও ক্রমে কচ্ছপের মত ভাসায় কঠিন পিঠ, ছেলেরা সেখানে দল বেঁধে হা-ডু-ডু খেলে বেলা অবেলায়। আমি মাঝে মাঝে ফড়িং খুঁজে ফিরে তাদের পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াতাম যেই সহস্র যোজন থেকে ছুটে এসে দিদি ছিনিয়ে নিয়ে যেত বাড়ির দেউড়িতে, ঠাস করে এক চড় মেরে খুব শাসিয়ে দিত- ভূতের থানে গিয়েছিস হতভাগা! আমি কাঁদতাম ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে দ্রুত ভাবতাম- মা যদি শোনেন তাহলেই সারা! আর ভেবেছি কোথায়- কখন যে দিদি একেবারে বুকে মিশে আছে দশ আঙ্গুলে সে কী আদর আমার সিঁথি নিমিষেই এলোমেলো ... তারপর শরৎ ছড়িয়ে যখন চোখে চোখে ঢেকে দিত ওকে মনে হতো মা! একদিন গাড়ির পরে গাড়ি কত গরু গাড়ি পথের পাশে ফেলে রেখে গেল লাল লাল ইট ভারী মজা হল - ইটের পরে ইট সাজিয়ে কত খেলা বেলা অবেলায়...! সে সময় কোথা থেকে এলো এক আজব পাগল - চলমান বুড়ো বট যেন সারাটা শরীর জুড়ে চিল-শকুনের বাসা আমার আতঙ্কের আশ্রয়ে নির্ভাবনায় শুরু করে বসবাস। ছেলেরা ঘিরে ধরে মরা পশু পাখি খাওয়া দেখে কৌতুকে, আমি শুনি দিদিকে শোনাই দিদি বলে- যাসনে ওদিকে ও কিন্তু ছেলেধরা! দিদিও কী কারণে ঘরকুনো হয়ে রয় বড় তাপসের দাদা আমাকে আদরে আটকাত চুপিসারে দিদি কী করে কেন ঘরকুনো-গৌণ এসব জানতে। একদিন, হৈ চৈ পড়ে গেল খুব- উ-হু, তাপসের দাদাকে নিয়ে নয় সেই যে পাগলটা, ইস্ এক পাজি ছেলে তার মাথা ফাটিয়েছে পাটকের ছুঁড়ে- আমার আতঙ্কের আশ্রয়ে যে ছিল দারুণ দূরন্ত সম্রাট, যে আজ স্বপ্ন পালক এক প্রহরাজীবী আলো হাতে আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেল আঁধার সঙ্কুল রাত্রির পথটুকু! * আলেকজান্ডার ব্লেকের দু’টি কবিতা -ভাষান্তর : মুহম্মদ সালাহউদ্দিন সন্ধ্যার আলোছায়া সন্ধ্যার আলো-ছায়া প্রায় বিলীন হয়ে আসছে লেকের উপর ছড়িয়ে আছে চাঁদের আলো; হৃদয়, আত্মা -এসবই নিমজ্জিত হয়ে আছে দুর্বোধ্য অন্ধকারে : ব্যাকুল ভাবনার এ ছায়াপথ স্ফুরিত হয়ে ওঠে অনুজ্জ্বলভাবে। দূর হতে স্বর্গের আলো দেখে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে হৃদয় লেকের উপর ছড়িয়ে আছে বিবর্ণ চাঁদের আলো; কে যেন কানে কানে গেয়ে যায় গান মৃদু শ্বাস নিয়ে আমি থাকি প্রতীক্ষায়; ক্ষীণ আলোয় অনুভব করি অনেক কিছু মহান কিছু হারিয়ে আমি আতঙ্কিত হই; এখন দ্বিধাহীনভাবে- সন্ধ্যার আলোছায়া নেমে যায় ঘন কুয়াশায় , অতিক্রান্ত দিনের কথা মনে পড়ে পুনরায়। স্বর্গের কাছাকাছি আরক্ত সূর্যাস্তের আলোয় শিশির বিন্দুর উপর আমি হেঁটেছি সূর্যোদয়ের গান আমার হৃদয়ে উঠছে জেগে আমি আমার স্বর্গের খুব কাছাকাছি। সন্ধ্যার মলিন আলো দীপ্ত সূর্যকে যখন বিবর্ণ করার প্রত্যয়ে লিপ্ত তখনই জ্বলবে তারারা জ্বলজ্বল করে। স্বর্গের সমুদ্র যখন হবে প্রবাহিত রক্ত আলো জ্বলতে থাকবে সারারাত আমার আত্মা থাকবে জেগে সূর্যোদয়ের গানের জন্য। আমি আমার স্বর্গের খুব কাছাকাছি; আরক্ত সূর্যাস্তের আলোয় শিশির বিন্দুর উপর আমি হেঁটেছি।
×