ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খেলাপী ঋণ কেনাবেচায় স্বতন্ত্র কোম্পানি হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২৩ জুন ২০১৯

খেলাপী ঋণ কেনাবেচায় স্বতন্ত্র কোম্পানি হচ্ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ খেলাপী ঋণ কেনাবেচা করতে স্বতন্ত্র কোম্পানি গঠনে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্বতন্ত্র কোম্পানি হলেও এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এজন্য বিভিন্ন দেশের ঋণ কেনাবেচার আইনী কাঠামোগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। গত মে মাসে দেশের সব ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বৈঠকে শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকাররা দেশের খেলাপী ঋণের লাগাম টানতে এবং ঋণ আদায়ে এই উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ব্যাংকের খেলাপী ঋণ কেনাবেচায় আইনী কাঠামো, ব্যবস্থাপনা ও মাঠ পর্যায়ে কাজের ধরন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কারণ ভারতে শেয়ারবাজারের মতো খেলাপী ঋণ নিয়ে একটি সেকেন্ডারি মার্কেট গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি এটি লাভজনক ব্যবসাও। এর ফলে ভারতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ অনেক কম। পাশাপাশি ব্যাংক ও ঋণ ক্রেতা উভয় পক্ষ লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেলাপী ঋণ কেনাবেচা হয়। সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলো থেকেও খেলাপী ঋণ কেনাবেচায় আইনী কাঠামো তৈরি করে একটি স্বতন্ত্র কোম্পানি গঠনের পরামর্শ এসেছে। আমরা বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দেশের আইনী কাঠামোগুলো পর্যালোচনা করছি। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে স্বতন্ত্র একটি কোম্পানি গঠন করা হবে। এই কোম্পানিই ঋণ কেনাবেচার আইনী নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব পালন করবে। ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কোনভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় খেলাপী ঋণ কেনাবেচার প্রক্রিয়া শুরু করা গেলে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে। এজন্য প্রয়োজন শক্ত আইনী কাঠামো। এ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত দরপত্রে অংশ নিয়ে খেলাপী ঋণ কিনবে। এরপর ওই ঋণের জামানত বাবদ গচ্ছিত সম্পদ নিজের জিম্মায় জব্দ করে ভোগদখল কিংবা বিক্রি করে দেয়ার আইনী ক্ষমতা পাবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এর আগে দেশে কিছু ঋণ এভাবে কেনাবেচা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত আইনী কাঠামো না থাকায় ঋণ কেনাবেচায় প্রাতিষ্ঠানিকতা পাইনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ঋণ কেনাবেচার আইনী কাঠামো তৈরি করতে কাজ শুরু করা হয়েছে। এই আইনী কাঠামোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে একটি কোম্পানি নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব পালন করবে। ব্যাংকগুলো যেসব খেলাপী ঋণ বিক্রি করতে চায় সেগুলো এই কোম্পানির কাছে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবে। এতে খেলাপীর নাম, ঠিকানা, মূল ঋণের পরিমাণ, সুদসহ ঋণের পরিমাণ, খেলাপীর জামানতের বিস্তারিত তথ্য, কত টাকায় ঋণটি বিক্রি করবে এসব তথ্যের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরবে। কোম্পানির একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে এসব তথ্য তুলে ধরা হবে ক্রেতাদের কাছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, খেলাপী ঋণ কেনার জন্য এজেন্টদের লাইসেন্স দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজেন্টরা প্রতিযোগিতামূলক দরে এসব খেলাপী ঋণ কিনতে পারবে। কেনার আগে এজেন্টরা ঋণখেলাপীর সম্পদ, জামানত এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার আইনী সুযোগ পাবে। কেনার পরও বন্ধকী সম্পত্তি ভোগদখল বা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতেও আইনী সুবিধা পাবে। ক্রেতা এ সম্পত্তির উন্নয়ন করে নিজে ভোগ করতে পারবে বা বিক্রি করতে পারবে। ঋণখেলাপি এগিয়ে এসে ক্রেতার সঙ্গে সমঝোতাও করতে পারে। তখন সবকিছু নির্ভর করবে ক্রেতার ওপর। জানা গেছে, ভারতসহ কয়েকটি দেশের আইন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। একটি খসড়া কাঠামোও তৈরি করা হয়েছে। এটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। খেলাপী ঋণ বেচাকেনার জন্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এমন সেকেন্ডারি মার্কেট গড়ে উঠেছে। সেগুলোতে খেলাপী ঋণ নিয়মিত বেচাকেনা হচ্ছে। এজেন্টরা খেলাপী ঋণ কিনে নিয়ে আদায়ও করছে। এভাবে খেলাপী ঋণ কেনাবেচা একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে গড়ে উঠেছে। এগুলোতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগও হচ্ছে। একে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থানের একটি বাজারও গড়ে উঠেছে। অনেকে খেলাপীঋণ সস্তায় কিনে নিয়ে সেগুলো পরিচালনা করে লাভজনকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এতে ওইসব দেশে খেলাপী ঋণের হার যেমন কম, তেমনি ব্যাংকের ঋণ উৎপাদনমুখী কাজে থাকায় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খেলাপী ঋণ বেচাকেনা করতে ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন কোম্পানি (এআরসি) রয়েছে। তারা ঋণখেলাপীদের সম্পত্তি কিনে নিয়ে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় এ ধরনের কোম্পানি গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এআরসি কোম্পানিগুলোর সব কাজকর্ম অর্থাৎ নীতিনির্ধারণ, অডিট, পরিদর্শন, কোম্পানির চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর নিয়োগ অনুমোদন ও অপসারণ করতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে পাওনা পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্ট এআরসিকে জরিমানাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে থাকে এআরসি কোম্পানি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি পূবালী ব্যাংকের এমডি থাকার সময় খেলাপী ঋণ আদায়ে এজেন্ট নিয়োগ করেছিলাম। তাদের অতি পুরনো কিছু খেলাপী ঋণ ছিল, যেগুলো আদায় হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, সেগুলো আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তারা বেশকিছু ঋণ আদায়ও করেছিল। পরে এটি আর বেশিদূর এগুতে পারেনি। কেননা তাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে কোন আইনী কাঠামো ছিল না। তিনি বলেন, শক্ত আইনী কাঠামো করে ঋণ কেনাবেচার ব্যবস্থা করা গেলে খেলাপী হওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে।
×