ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

জিয়া সম্পর্কে জেনারেল শওকত যা বললেন

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ২২ জুন ২০১৯

 জিয়া সম্পর্কে জেনারেল শওকত যা বললেন

১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। আমি তখন যুক্তরাজ্যে ইমিগ্রেশন এডভাইজরি সার্ভিসের ট্রাইব্যুনাল কাউন্সিলর পদে নিয়োজিত। ১৯৬৯ সালের ইমিগ্রেশন আপিল এ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী সৃষ্ট এই সংস্থা মূলত ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণের উপরে ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করত। এটি চালাতেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একদিন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমাকে ফোনে বললেন তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলীকে নিয়ে আমার দফতরে আসতে চান। আমি বললাম, স্বাগতম। গাফ্ফার ভাই এক অর্থে সে সময় আমার ব্যবসায়ী অংশীদারও ছিলেন। কেননা আমরা দশজন মিলে তখন ‘নতুন দিন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করি। লে. জেনারেল মীর শওকতকে নিয়ে কেন গাফ্ফার ভাই আসতে চাইলেন তা অনুধাবন করতে আমার সময় লাগেনি। জেনারেল শওকত কিছুদিন আগেই যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের কারণে। এই পরিস্থিতি নিয়ে তখন যুক্তরাজ্যের বাংলা কাগজগুলোতে বেশ উৎসাহী সংবাদ এবং মন্তব্য ছাপা হচ্ছিল। গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক তখন বেশ নিবিড়। রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পর জে. শওকত গাফফার ভাইয়ের পাশের রাস্তায়ই বাড়ি কিনেছিলেন মিডলসেক্সের এজওয়ার এলাকায়। কথা অনুযায়ী গাফ্ফার ভাই জেনারেল শওকতকে সঙ্গে নিয়ে এলেন ইমিগ্রেশন এডভাইজরি সার্ভিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আমার দফতরে। গাফ্ফার ভাই সংক্ষিপ্ত সূচনা দিয়ে আলোচনা শুরু করার পর জেনারেল শওকত তার কাহিনী ব্যক্ত করলেন। সংক্ষেপে যা বললেন- তাকে সম্প্রতি জিম্বাবুইয়েতে বদলির আদেশ দেয়া হয়েছে, যা তিনি মেনে নিতে পারছেন না এই কারণে যে, তার ভয় জিম্বাবুইয়ের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে ঢাকা গেলেই এরশাদ তাকে গ্রেফতার করবেন। কেননা এরশাদ সাহেবের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব চলছিল। সব শুনে আমি জেনারেল শওকতকে বললাম, ‘আপনি বিলেতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য দরখাস্ত করলে আমি সেটা করিয়ে দেব।’ কিন্তু মীর শওকত নারাজ। তার কথা যেহেতু তিনি ভবিষ্যতে রাজনীতি করবেন, তাই রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া তার জন্য ঠিক হবে না। তিনি আবদার করলেন আমি যেন এমনিতেই তাকে যুক্তরাজ্যে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করি। আমি ইতিবাচক সাড়া দেয়ায় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তার বিলেতে থাকার অনুমতির আলোচনা শেষ হলো। ঠিক তখনই আমার একান্ত সচিব টিনা রাওয়াল এসে জানাল যে, আমাদের পরিচালক মাইকেল বার্ণস সাহেব চাচ্ছেন আমি যেন জেনারেল শওকত এবং গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে তার কামরায় যাই চা পান করতে। ইমিগ্রেশন এডভাইজারি সার্ভিসের সে সময়ের পরিচালক মাইকেল বার্ণস আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। যে ক’জন এমপি প্রথম থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন, মাইকেল বার্ণস তাদের অন্যতম। তিনি পশ্চিম বাংলায় উদ্বাস্তু শিবিরেও গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তার ছিল নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। তিনি শুরু থেকেই সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন, ড. শফিক সিদ্দিকী, ড. সেলিম, সৈয়দ আশরাফ প্রমুখের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যে সংস্থার জন্ম হয়েছিল। আমি নিজেও সে সংস্থার একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সে অর্থে মাইকেল বার্ণসের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা শুধু উর্ধতন-অধঃস্তন কর্মকর্তার সম্পর্কই ছিল না, আমরা উভয়েই ছিলাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোচ্চার। আইরিশ নোবেল বিজয়ী শান্তির দূত শোন ম্যাকব্রাইটের প্রয়াণের পর মাইল বার্ণস ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। তবে ইমিগ্রেশন এডভাইজরি সার্ভিসের পরিচালক থাকাকালীন তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি এবং শোন ম্যাকব্রাইট ছিলেন সভাপতি। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে সালে মাইকেল বার্ণস লিগেল সার্ভিসেস অমবাডসমেন নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। মাইকেলের প্রস্থানের পর আমি ইমিগ্রেশন এডভাইজরি সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের পদপ্রাপ্ত হই। তার পূর্বে আমি ছিলাম আইন বিষয়ক উপ-পরিচালক। গাফ্ফার ভাই এবং জেনারেল শওকতকে মাইকেল বার্ণসের কামরায় নিয়ে গেলে তিনি এই বলে জেনারেল শওকতকে স্বাগত জানালেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধাবোধ। আলোচনা কিছুদূর এগুনোর পর জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গ আসতেই জেনারেল শওকত দ্বিধাহীন কণ্ঠে যা বললেন, বাংলায় তার তর্জমা নিম্নরূপ : ‘অনেকেই জানে না জেনারেল জিয়া কি ধরনের মুক্তিযোদ্ধা, তিনি মন-মানসিকতা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি গিয়েছিলেন সোয়াত নামক জাহাজ থেকে পাকিস্তানী সমরাস্ত্র খালাস করতে। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন বাঙালী সৈন্যরা। তারা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে তাকে বাঙালী সৈন্যরা হত্যা করবে এ কথা জানার পরই নিজের প্রাণের ভয়ে জিয়াউর রহমান ভোল পাল্টিয়ে বাঙালীদের সঙ্গে এলেন ভয়ে এবং অনেকটা অভিনয়ের ছলে। তিনি ছিলেন পাকিস্তানপ্রেমী এক লোক। যিনি পাকিস্তান ভেঙে ফেলাকে মোটেও সুনজরে দেখেননি এবং তাই রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করার পর তিনি জয় বাংলা স্লোগান বন্ধ করেছিলেন, শাহ আজিজসহ সব শীর্ষ রাজাকারদের রাষ্ট্রীয় পদে বসিয়েছিলেন, পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ও বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন, ইন্দিরা মঞ্চ নস্যাত করেছিলেন, যারা ’৭১-এ বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলেন, জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী দল তাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানী সরকার এবং সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে গভীর এবং গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং বাংলাদেশে আইএসআইর ঘাঁটি বসাতে দিয়েছিলেন।’ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ প্রসঙ্গে জেনারেল শওকত বললেন বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা জিয়ার আগে অনেকেই বেতার মাধ্যমে পড়েছে তার মধ্যে আব্দুল হান্নানের এবং আবুল কাশেম সন্দ্বীপের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে একজন সামরিক কর্মকর্তাকে দিয়ে এটি পড়াতে পারলে ভাল হয় এই ধারণা নিয়ে জিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় ভাষণটি পড়তে। জিয়া প্রাথমিকভাবে ভাষণটি পড়তে ইচ্ছুক ছিলেন না, পরে প্রাণের ভয়ে এটি পড়েন। জেনারেল শওকতের কথাগুলো শুনে মাইকেল বার্ণস অনেকটা হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মাস পূর্বে মাইকেল বার্ণসের প্রয়াণ হয়েছে, কিন্তু জেনারেল শওকতের সে কথার সাক্ষী হিসেবে আজও বেঁচে আছি আমি এবং গাফ্ফার ভাই। আমি চট্টগ্রামভিত্তিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম বীর বিক্রমের লেখা ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইটি পড়েছিলাম। জেনারেল শওকতের ভাষ্যের সঙ্গে মেজর রফিকের বিবরণী হুবহু মিলে গেল দেখে জেনারেল শওকতের কথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। এ ছাড়া ভারতে বসে মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নামে যে বইটি লিখেছেন, সেটিও পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমার, যে বইতে কাদের সিদ্দিকী লিখেছেন যে, কর্নেল ওয়ালি জিয়াকে বলেছিলেন জিয়া পাকিস্তানীদের সঙ্গে থাকলে কর্নেল ওয়ালিই তাকে খুন করবেন। তদুপরি জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জবর দখলের পর যে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা স্লোগান নস্যাত করে দিয়েছিলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিহ্ন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের চিহ্ন, নিশ্চিহ্ন করেছিলেন, এগুলো তো সবই দৃশ্যমান ইতিহাস। তার অতি নিকট দু’জন, যথা ব্যারিস্টার মওদুদ এবং ক্যাপ্টেন নুরুল হকও এ কথাগুলো প্রকাশ করেছেন তাদের লেখা বইতে। জিয়ার কেবিনেটের অন্যতম মন্ত্রী ক্যাপ্টেন নুরুল তার বই ‘হাই টাইড, হাই টাইম’-এ বিভিন্ন জায়গায় লিখেছেন কিভাবে জিয়া স্বাধীনতার শত্রুদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বন্দুকের জোরে দখলের পর তিনি শর্ষিনার পীরের মতো এক ধিকৃত রাজাকারকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছিলেন, যে পীর বলেছিল ’৭১-এ পাকিদের দ্বারা ধর্ষণ ছিল জায়েজ। এই ঘটনাগুলো পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, জিয়া স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি এবং মেনে নিতে পারেননি। তার রাজনীতির মূল পুঁজি ছিল ভারত বিরোধিতা এবং হিন্দু বিদ্বেষ যার কারণে সকল পাকিপ্রেমিরা তার ছায়াতলে জড়ো হয়েছিল তাকে ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়ে। জেনারেল শওকত যখন যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার জন্য আমার সহায়তা চেয়েছিলেন, তখন তিনি বিএনপিতে যোগ দেননি, যদিও রাজনীতি করবেন এমন ইচ্ছে তার ছিল। তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেবেন এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য পরে বিএনপিতেই গিয়েছিলেন। আমাদের সহায়তায় সেদিনের যুক্তরাজ্যের খোদ ইমিগ্রেশন বিষয়কমন্ত্রী টিমতি রেন্টন ১৯৮৮ সালের ২৬ জুলাই জেনারেল শওকতকে যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি দিয়ে আমাদের কাছে চিঠি লেখেন। জে. শওকত যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতির জন্য যে আমার সহায়তা চেয়েছিলেন সেটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এমনি একটি পত্রিকার খবরের ফটোকপি তুলে ধরা হলো। লেখক : আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি
×