ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উন্মাদনার ভারত-পাকিস্তান লড়াই আজ

প্রকাশিত: ১০:৩১, ১৬ জুন ২০১৯

উন্মাদনার ভারত-পাকিস্তান লড়াই আজ

শাকিল আহমেদ মিরাজ ॥ ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান লড়াইকে তুলনা করা যায় কেবল ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচের সঙ্গে। নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই, গোটা বিশ্ব যেখানে দুই ভাগে বিভক্ত! মাঠ-গ্যালারি ছাপিয়ে যে দ্বৈরথের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে, অগণিত ক্রীড়াপাগল মানুষের মনে। ভারত-পাকিস্তান লড়াই তাই বিশ্বকাপের মধ্যে অন্য বিশ্বকাপ, উন্মাদনার মাঝে অন্য উন্মাদনা। এমনিতে চিরশত্রু দু’দেশের ম্যাচ ঘিরে থাকে আগুন উত্তাপ, বিশ্বকাপ তাতে যোগ করে বাড়তি মাত্রা। ম্যানচেস্টারের ঐতিহাসিক ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে তিনটায় শুরু সেই ক্রিকেট যুদ্ধ, মাঠ ও টেলিভিশন মিলিয়ে যা দেখতে মুখিয়ে প্রায় দুই শ’ কোটি দর্শক! বিরাট কোহলির ভারত এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট। রোহিত শর্মা, মহেন্দ্র সিং ধোনি, ভুবনেশ্বর কুমার, জাসপ্রিত বুমরাহদের নিয়ে দারুণ ব্যালান্সড। অন্যদিকে সময়টা খুব ভাল না গেলেও আয়োজক ইংল্যান্ডকে হারানো সরফরাজ আহমেদদের নিয়ে যেকোন প্রতিপক্ষই ভাবতে বাধ্য। পাকিদের ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ তকমাটাই হতে পারে ভারতের জন্য ভয়ের বড় কারণ! তবে সব উন্মদনায় জল ঢেলে দিতে পারে বৃষ্টি! ইংল্যান্ডে চলমান ১২তম বিশ্বকাপের এ পর্যায়ে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু এটি। টুর্নামেন্টের অর্ধেক পথেই বৃষ্টির কারণে চার-চারটি ম্যাচ প- হয়েছে, বিশ্বকাপের ইতিহাসে যা নতুন রেকর্ড। স্থানীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস ম্যানচেস্টারে সকাল ৬টা থেকে ৮টা এবং দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত জোরালো বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। সারাদিনই থেমে থেমে চলতে পারে সেটি! অসহায় আইসিসি ইতোমধ্যে জানিয়েছে, প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। তাই বলে উন্মাদনার ম্যাচ নিয়ে দু-দলের ভক্ত-সমর্থকদের মাঝেও উত্তেজনার কোন কমতি নেই। এবার বাড়তি উত্তেজনার পেছনে বড় একটা কারণও রয়েছে। সম্প্রতি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় ভারতীয় অনেক ভারতীয় সেনা হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু-দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ভারত ওই আক্রমনের জন্য পাকিস্তানী জঙ্গীগোষ্ঠীকে দায়ী করে পাল্টা বিমান হামলা চালালে অনেক পাকিস্তানী নিহত হয় বলে খবরে প্রকাশ। ওই অবস্থায় বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ বয়কটের আহবান জানিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)! কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) মধ্যস্ততায় অবস্থার পরিবর্তন হয়। দেশ দুটির গনমাধ্যম, ক্রিকেটানুরাগী এমনকি সাবেক তারকাদের মধ্যে এই ম্যাচ নিয়ে বাগযুদ্ধ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ১৯৭৮ থেকে এ পর্যন্ত দু-দল মোট ১৩১টি ওয়ানডেতে মুখোমুখি হয়েছে। যেখানে ভারতের ৫৪টির বিপরীতে পাকিদের জয় ৭৩ ম্যাচে, পরিত্যাক্ত ৪, সাফল্য ৫৭.৪৮ ভাগ। তার মানে ওয়ানডেতে মহেন্দ্র সিং ধোনিদের তুলনায় এগিয়ে সরফরাজ আহমেদের দল। এই তথ্যে পাকিস্তানী ভক্তদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই- ১৯৯২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বিশ্বকাপে ছয়বার মুখোমুখি হয়ে শত্রু দেশের কাছে প্রতিবারই হেরেছে পাকিস্তান! তবে তাদের জন্য প্রেরণা হতে পারে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সাফল্য। ফেবারিট না হয়েও এই ইংল্যান্ডেই গ্র্যান্ড ফাইনালে এই ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল সরফরাজের দল। সেদিন জয়ের কারিগর মোহাম্মদ আমির, ফকর জামান, বাবর আজমদের বেশিরভাগ সদস্য এই ম্যাচেও আছেন। ভারতীয় গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর, সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক মিসবাহ তাই একমত, স্নায়ুর চাপ জয় করে যারা সামর্থ্যরে পুরোটা দিতে পারবে শেষ পর্যন্ত তারাই জিতবে। আর উত্তরসরীদের উদ্দেশ্যে ওয়াসিম আকরামের বার্তা,‘এটা কোনও যুদ্ধ নয়, একটা ক্রিকেট ম্যাচ। শান্ত থাক এবং নিজেদের খেলাটা খেল।’ আরেক সাবেক পাকিস্তান তারকা শোয়েব আকতারের মতে, ম্যাচ জিততে হলে সরফরাজদের আজ ‘এ-প্লাস’ ক্রিকেট খেলতে হবে, গতানুগতিক নয়। কারণ প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত শক্তিশালী এবং দুর্দান্ত। আর ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব মনে করেন, এই পাকিস্তানকে কোহলির দল দশ বারের মধ্যে অন্তত সাত বারই হারাবে। এসব শুনে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে শান্ত থাকাটা আসলেই মুশকিল। নমুনা দেখুন, পঁচিশ হাজার ধারণ ক্ষমতার ওল্ডট্র্যাফোর্ডে ম্যাচটা দেখতে টিকেটের জন্য আবেদন পড়েছিল সাড়ে সাত লাখ! বৃষ্টি-বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত খেলা মাঠে গড়ালে বিশ্বজুড়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ টিভিতে খেলা দেখবেন। খেলা হবে কি হবে না, সেটি পরের বিষয় চলতি সপ্তাহে ম্যাচচেষ্টারে অন্তত বিমানের দশটির বিশেষ ফ্লাইট অবতরণ করেছে, যারা সবাই ভারত এবং পাকিস্তানের, আগে থেকেই টিকেট করে রেখেছিলেন। ম্যাচটি ঘিরে যাতে কোনরকম হাঙ্গামা তৈরি না হয় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন থেকে সেজন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ৩ ম্যাচে ২ জয় ও ১ পরিত্যক্ত ম্যাচের পয়েন্ট ভাগাভাগি করে চার নম্বরে থাকা ভারতের পয়েন্ট ৫। ৪ খেলায় ১ জয়, ২ হার ও পরিত্যক্ত ১ ম্যাচের পয়েন্ট ভাগাভাগি করে আট নম্বরে পাকিস্তান। দক্ষিন আফ্রিাকে ৬ উইকেটে হারিয়ে মিশন শুরু করা কোহলির ভারত এরপর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তুলে নেয় ৩৬ রানে জয়। তবে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে তাদের শেষ ম্যাচটা বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১০৫ রানে অলআউট হয়ে লজ্জার হারের পর ফেবারিট ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪ রানের জয়ে আলোচনায় উঠে আসে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ পাকিস্তান। বৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। আর টনটনে আগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৪১ রানে হারে সরফরাজের দল। ১৯৯২ বিশ্বকাপে প্রথম মুখোমুখি হয় দু-দল। সেবার ভারতের কাছে ৪৩ রানে হারলেও শেষ পর্যন্ত ট্রফি জয় করে ইতিহাস গড়েছিল পাকিস্তান। ১৯৯৬-এ ৩৯ রানে, ১৯৯৯ সালে ৪৭ রানে, ২০০৩ বিশ্বকাপে ৬ উইকেটের, ২০১১ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের কাছে ২৯ রানে হারে শহীদ আফ্রিদির পাকিস্তান। সবশেষ ২০১৫ সালে মিসবাহর পাকিস্তানকে ৭৬ রানে হারিয়েছিল ধোনির ভারত। ওই ম্যাচে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহলি (১০৭)। সবশেষ গত বছর এশিয়া কাপে সরফরাজের পাকিস্তানকে ৯ উইকেটে হারায় কোহলির ভারত। জোড়া সেঞ্চুরি করেন রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান। দূর্ভাগ্য ইনজুরির কারণ ধাওয়ান আজ নেই। পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ ৭৮ রান করা অভিজ্ঞ শোয়েব মালিক পাকিস্তান স্কোয়াডে। নিজের শেষ বিশ্বকাপে তারকা অলরাউন্ডার কেমন করেন, সেটি দেখার অপেক্ষায় তার দেশ। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বেরসিক বৃষ্টি জল ঢেলে না দিলে, বিশ্বজুড়ে অগনিত ক্রিকেটপাগল মানুষই আসলে ম্যাচটি ঘিরে অধীর অপেক্ষায়।
×