ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্রোহী কবির নারী চেতনা

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ২৪ মে ২০১৯

বিদ্রোহী কবির নারী চেতনা

উনিশ শতকে নবজাগরণের সিদ্ধ পুরুষরা যখন আধুনিকতার বলয়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করলেন তখন তাদের অনুধাবন হলো ঘরে আটকে থাকা নারীদের চার দেয়ালের বন্দী জীবন থেকে বের করে আনতে হবে। শুধু তাই নয় শিক্ষার অবারিত দ্বারও তাদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগরসহ আরও কিছু কলকাতার বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব অর্ধাংশ এই অংশের ব্যাপারে সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করলেন। বিদ্যাসাগর তো একেবারে প্রত্যক্ষ কর্মযোগে নারী শিক্ষাকে সার্বজনীন করতে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়কে নারী মুক্তির উপায় নির্ধারণে প্রয়োগ করলেন। বাল্য ও বহুবিবাহ রোধ বিধবা বিয়ে আইনসিদ্ধ করাসহ আরও কিছু নারী কল্যাণমূলক বিষয়কে বিবেচনায় আনতে তৎপর হলেন। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর নারী মুক্তি হাঁটি হাঁটি পা পা করেও সেভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত হতে পারেনি। হাতেগোনা গুটিকতক মেয়ে নারী শিক্ষার দ্বারপ্রান্তে আসলেও সিংহভাগ গোষ্ঠী প্রায়ই অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকে। বিদ্যাসাগরের হাত দিয়ে নারী শিক্ষার শুভযাত্রা শুরু হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকেও তার আবেদন ছিল সামান্যই। এই শতাব্দীর আশি আর নব্বইয়ের দশক ছিল অপরাজেয় রবীন্দ্র প্রতিভার অপ্রতিহত গতি যা শুধু সাহিত্যের আঙ্গিনায়ই নয়, বৃহত্তর সামাজিক বলয়েও যুগান্তকারী অবদান রাখে। সে সময়েও রবীন্দ্র সৃষ্টিযজ্ঞের দিকে মনোনিবেশ করলে বোঝা যায় এমন সমাজ সচেতন শৈল্পিক সুষমায়ও কবি গুরু নারী মুক্তির অবারিত দ্বারকে খুলে দিতে সেভাবে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের মনন ও সুজনশীলতায় নারী-চরিত্রগুলো প্রচলিত সমাজ সংস্কারের কঠিন আবর্তে নিশ্চল, অচলায়তনের বেড়াজাল ডিঙাতে পারেনি। আর ১৮৯৯ সালে জন্ম নেয়া বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্তের সময় উপমহাদেশীয় যে ঝড়-ঝঞ্ঝার আবহ দেখেন সেখানে পশ্চাদপদ নারী সমাজই ছিল সব থেকে বেশি অবহেলিত এবং নির্যাতিত। ফলে বিশ শতকীয় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাবানলের দুঃসময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রত্যক্ষ করলেন সর্ব মানুষের অসহায়ত্ব আর পিছিয়ে পড়া নারী জাতির সম্মান ও মর্যাদা হানির এক করুণ আখ্যান। অধিকার বঞ্চিত এই নির্লিপ্ত গোষ্ঠী জানেও না কোথায় তাদের স্বাধীনতা, ন্যায্য পাওনাই বা কি। বিদ্রোহী সত্তা নিয়ে জন্ম নেয়া এই লড়াকু কবি ঠান্ডা মাথায় নয় উন্মত্ততা আর উন্মাদনায় ক্ষেপে উঠলেন। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বজ্র কঠিন কণ্ঠে হুঙ্কার তুললেন- চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না, হাতে রুলি, পায়ে মল, মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেলো নারী, ভেঙ্গে ফেলো ও শিকল। যে ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ। দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন, ঐ যত আভরণ। জীবনভর নারী শক্তির পূজারী এই দরাজ কণ্ঠ সব সময়ই অন্তঃপুর বাসিনীদের প্রতিদিনের বন্দিত্বকে মুক্ত করতে তাঁর সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিনায় দৃপ্তকণ্ঠে তাদের শিকল ভেঙ্গে ফেলতে উদাত্ত আহ্বান জানান। অবরোধ প্রথা, বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ বিশ শতকীয় পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এমন ন্যক্কারজনকভাবে দৃশ্যমান ছিল নজরুলের মতো মানবিক এবং সর্ব মানুষের সৃজনসত্তা প্রতিনিয়তই এমন অপসংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। প্রতিপক্ষ শক্তিকে তীক্ষ্ম বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন। কবিতায় তো অনেকখানি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধই শুধু নয় বক্তৃতা, সভা সমিতি সর্বক্ষেত্রে নারী জাতির শেকল ভাঙ্গার জয়গান গেয়ে। দীপ্ত কণ্ঠে বলতে দ্বিধা করেননি শুধু সমাজ কিংবা পুুরুষ নয় নারীরা নিজেই তাদের চলার পথের সবচেয়ে বড় বাধা। কবি মনে করতেন নিজেকেই বহু বন্ধন জাল ছিন্ন করে মুক্ত আবেশে শামিল করতে হবে। অবরোধ প্রথার নামে যে শ্বাসরোধ তৈরি করা হয়েছে তাতে নারীরা সচকিত না হয়ে বরং এমন অপসংস্কারকে ভাগ্যবিধাতা বলে মানতেও কসুর করেনি। ঘরের ভেতর থেকে অর্গল তুলা নারীরা কত প্রতিভাদীপ্ত মনন নিয়ে জন্মায় তার খোঁজ তারা নিজেরাও জানেন না। অন্যের জানার তো প্রয়োজনই নেই। নজরুলের বক্তব্যই তুলে ধরা যায়- ‘আমাদের দেশের মেয়েরা ব হতভাগিনী। কত মেয়েকে দেখলাম কত প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভাবনা তাদের শুকিয়ে গেল সমাজের প্রয়োজনের দাবিতে। ঘরের প্রয়োজন তাদের বন্দিনী করে রেখেছে। এত বিপুল বাহির তাদের চায়, তাদের ঘিরে রেখেছে বারো হাত লম্বা আট হাত চওড়া দেয়াল। বাইরের আঘাত এ দেয়ালে বারে বারে প্রতিহত হয়ে ফিরল। এর বুঝি ভাঙ্গন নেই অন্তর হতে মার না খেলে। তাই নারীদের বিদ্রোহিনী হতে বলি। তারা ভেতর হতে দ্বার চেপে ধরে বলছে আমরা বন্দিনী। দ্বার খোলার দুঃসাহসিকা আজ কোথায়? তাকেই চাইছেন যুগ দেবতা। দ্বার ভাঙ্গার পুরুষতার নারীদের প্রয়োজন নেই; কারণ তাদের দ্বার ভেতর হতে বন্ধ, বাহির হতে নয়।’ কবির মতে অবরোধ প্রথার কঠিন নিগড়ে যারা আটকে থাকে তাদেরই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেই রুদ্ধকারে করাঘাত করতে হবে। মুক্তির দরজায় বন্দিনী নারীদের কড়া নাড়তে হবে। ভেতর থেকে উদ্দীপ্ত হতে হবে শেকল ভাঙার চেতনায়। কঠোর পর্দা প্রথা নারী শিক্ষার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আর শিক্ষা ছাড়া নারীর সার্বিক বাধন মুক্ত হওয়া কঠিন। নজরুলের ক্ষোভ আর আক্ষেপ ছিল অজ্ঞানতার অন্ধকারে নারীদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে বন্দী করে রাখায়। অশিক্ষার কালো ছায়ায় গৃহাভ্যন্তরের বন্দিনীরা এমনভাবে অসহায়ত্ব আর পঙ্গুত্বে আবর্তিত হয় সেখানে তাদের পুরো শক্তিমত্তা খর্বিত হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে বাধা দেয়। সেখান থেকে নব উদ্যোমে চেতনা শাণিত করতে না পারলে আলোকিত জীবনের আশা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। বিংশ শতাব্দীর নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া যেভাবে সমাজ-সংস্কারের অনেক নিয়ম-শৃঙ্খলাকে ভেঙ্গে নিজেও শিক্ষা লাভ করে সদর্পে অবরোধ প্রথাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে আসেন। এমন মহীয়সী নারীই নজরুল ইসলামের আরাধ্য নারী শক্তি। নজরুল মনে করতেন বেগম রোকেয়ার মতো নারী জাগরণের বলিষ্ঠ নায়ক আমাদের সমাজের জন্য বড় বেশি প্রয়োজন। যেভাবে নারী শিক্ষা ও মুক্তির জয়গান গেয়ে অবিভক্ত বাংলাকে উদ্দীপ্ত করলেন তা শুধু বিশেষ গোষ্ঠীর বাঁধন ছেঁড়ার নিশানা নয় বরং অবহেলিত, শোষিত ও বঞ্চিতদের শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার গভীর আবেদনও। নারী মুক্তির দিশারী এই বিরল ব্যক্তিত্ব সমকালে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন নজরুল ছিলেন তার প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা। বেগম রোকেয়ার প্রতি শ্রদ্ধায় বিগলিত নজরুল ভাবতেন পর্দা প্রথার আড়ালে থাকা নারীদের জন্য এমন অভিভাবক সত্যিই প্রয়োজন যার বলিষ্ঠ কর্মপ্রক্রিয়ায় মেয়েদের বাইরে বের হয়ে আসার সুযোগ তৈরি হবে। কর্মবীর আর এমন সৃজন ব্যক্তিত্ব তার লেখায় এবং কাজে যে মাত্রায় নারী জাতির আলোকিত জগতে পা রাখার উদাত্ত আহ্বান জানান তা সত্যিই নজরুলের মতো এমন বিদ্রোহী কণ্ঠকেও অভিভূত করে দেয়। সুতরাং নজরুলের নারী-ভাবনা সমকালীন সমাজের অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক অভাবনীয় মননও সৃজন দ্যোতনা। ছান্দিক আবহে কবিতার মর্মবাণী ঝঙ্কৃৃত হয়েছে নারীর প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতায়। ছোট গল্প আর উপন্যাসেও আছে নারী নিপীড়নের কাহিনী সেখান থেকে স্বাধীন সত্তায় উজ্জীবনের দ্যুতি সেভাবে বিকিরণ করতে না পারলেও সমকালীন আর্থ-সামাজিক পেষণে নারী নিগ্রহের যে বেদনাবিধুর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সেখান থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না অর্ধাংশ এই জাতির প্রতি নজরুলের যে সচেতন দায়বদ্ধতা, গভীর সহানুভূতি আর আন্তরিক মহানুভবতা। নারীকে নিয়ে অন্তনিঃসৃত বেদনায় ভাবতেন, শৃঙ্খল মুক্তির উপায় নির্ধারণ করেন সর্বোপরি নারীকে মানুষ ভাবার অভিব্যক্তিও ভেতর থেকে জেগে ওঠে। বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি, কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
×