ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবির অন্তরালে

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১৪ নভেম্বর ২০১৮

নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবির অন্তরালে

নির্বাচনী ঢোল যেন বেজেও বাজতে চায় না। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন ২৩ ডিসেম্বর। বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের নতুন নামের জোট ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বহু আগেই জানতেন নির্বাচন কবেতক হতে পারে এবং সরকার নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন বর্জনের বা বানচালের হুমকি দেয়া সত্ত্বেও বিএনপিও তলে তলে নির্বাচন-প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বাইরে দেখিয়েছে, তাদের সাত দফা দাবি মানা না হলে তারা আন্দোলনে যাবে। তাদের ফ্রন্টনেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, দাবি আদায় না করে তারা ঘরে ফিরবেন না। কিন্তু যথাসময়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেছেন এবং নির্বাচনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা দাবি জানিয়েছেন, নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ পিছিয়ে দেয়া হোক। নির্বাচন কমিশন সে দাবিও মেনে নিয়ে নির্বাচনের তফসিল এবং তারিখ পরিবর্তন করেছে। নির্বাচনের নতুন তারিখ ৩০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ তারিখটি এক সপ্তাহ পেছানো হয়েছে। তাতে প্রধান বিরোধী জোট খুশি নয়। তারা চায় নির্বাচনের তারিখ আরও পেছাতে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তা সম্ভব নয়। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, ‘‘চালাকি দ্বারা কোন মহৎ কাজ হয় না।” বিএনপির রাজনীতিতে এই চালাকি করার প্রবণতাটা এখনও গেল না। বর্তমান চালাকিরও একই উদ্দেশ্য, নির্বাচন বানচালন করা। তারা বুঝেছে, আন্দোলনের হুমকি দিয়ে নির্বাচন বানচাল করা যাবে না। নির্বাচন বর্জন করলে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের দুর্গতিটা তাদের কপালে আরও বড় হয়ে দেখা দেবে। সুতরাং নির্বাচনে যোগদানের ঘোষণা দিয়ে যদি তার পর নানা ফ্যাকড়া তুলে নির্বাচন বানচাল করা যায়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আরও পেছানোর ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছে এটা ভাল খবর। কিন্তু বিরোধী দলকে আরও কিছুটা কনসেসন দিয়ে ‘সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের’ দাবিকে সম্মান জানানোর জন্য নির্বাচনের তারিখ আরও কিছুটা (আরও এক সপ্তাহের বেশি নয়) পেছাতে চায়, সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, এই পেছানোর দাবির পেছনে নির্বাচন বানচালের একটা প্রচ্ছন্ন ষড়যন্ত্র আছে। সেই ষড়যন্ত্র যাতে সফল না হয় সেদিকে তারা কঠোর দৃষ্টি রাখবে এবং সরকারকেও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। পাকিস্তান আমলে এটা ছিল মুসলিম লীগের খেলা। ক্ষমতায় বসেও তারা নির্বাচন পেছানোর অর্থাৎ নির্বাচন বানচাল করার খেলা খেলেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক নির্বাচন তারা আট বছর ঠেকিয়েছে। ৩৫টি উপনির্বাচন হতে দেয়নি। একটি উপনির্বাচনে পরাজিত (টাঙ্গাইল) হওয়ার পর জয়ী আওয়ামী লীগ সদস্যকে প্রাদেশিক আইন পরিষদে ঢুকতে না দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সর্বপাকিস্তানী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়নি ২৪ বছর। স্বাধীন বাংলাদেশে মুসলিম লীগ রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করে বিএনপি। নামটি অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু চরিত্রে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তার বাহন। ভারতে যেমন সাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভা থেকে অসাম্প্রদায়িক নাম নিয়ে বিজেপির জন্ম, স্বাধীন বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ রাজনীতির পুনর্জন্ম অসাম্প্রদায়িক বিএনপি নামের খোলাস নিয়ে। বাংলাদেশে বিএনপি এখন একটি বিরোধী দল। কিন্তু গণতন্ত্রের রাজনীতি নয়, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তাদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। কথায় বলে, ‘একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর।’ বিএনপি জোটেও এখন সুগ্রীবদের আবির্ভাব ঘটেছে। ড. কামাল হোসেন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপি জোটে এসেছেন। জীবনে একটি নির্বাচনেও (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একবার নির্বাচিত হওয়া ছাড়া) জয়ী হননি। এ ব্যাপারে মাহমুদুর রহমান মান্নার রেকর্ডও প্রায় একই রকমের। এরা এখন বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়েছেন যদি নির্বাচন এড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। বিএনপি বর্জন দ্বারা নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি। এখন নির্বাচনে যোগদান করে অন্য প্রক্রিয়ায় যদি তা বানচাল করা বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন করা যায়, এটাই তাদের লক্ষ্য। ব্রিটেনে বহুকাল বাস করি। দেখেছি, ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছানুযায়ীই নির্বাচনের দিন-তারিখ স্থির হয়। ক্ষমতাসীন দল (টোরি বা লেবার যারাই হোক) যদি মনে করে বিরোধী দল এখন বেকায়দায় আছে, তাহলে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ দূরে থাকলেও আগেই তারা নির্বাচন দেয়। বিরোধী দল তা মেনে নেয়। নির্বাচন পেছানোর আব্দার ধরে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, তার সুযোগ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন দিয়েছিলেন। ব্রিটেনেও ব্রেক্সিট নিয়ে থেরেসা মে’র সরকার এতই বিপাকে আছে যে, মাঝখানে শোনা গিয়েছিল, করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টির অপ্রস্তুত অবস্থার কথা জেনে তিনি একটি নির্বাচন সময়ের আগেই দেবেন। লেবার নেতা করবিন তার বিরোধিতা করেননি, বরং বলেছিলেন, “লেবার পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে শুধু প্রস্তুত নয়, নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যেতেও প্রস্তুত।” বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যে অবস্থা, তাতে তারা নির্বাচনে জয়ী হবে, তার হান্ড্রেড পার্সেন্ট সম্ভাবনার কথা কেউ বলে না। এই অবস্থা আরেকটু চাঙ্গা করার জন্য যে কোন অজুহাতে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন বেশ কিছুটা পেছানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। এই টালবাহানা করা শেখ হাসিনার চরিত্রে নেই। তিনি ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ হলেই সাধারণ নির্বাচন দিয়ে নির্বাচকম-লীর সম্মুখীন হতে ভালবাসেন। ২০০১ সালেও তিনি তাই করেছিলেন। এবারেও তাই করেছেন। কিন্তু বিএনপি-শিবিরেই দেখা যাচ্ছে, একটা পলায়নী মনোভাব। নির্বাচন কমিশন তাদের দাবি মেনে সাতদিন নির্বাচন পিছিয়েছে তা তাদের মনোপুত নয়। তারা আবার ড. কামাল হোসেনকে সামনে শিখ-ি খাঁড়া করে যাচ্ছেন, নির্বাচন কমিশনারের কাছে নির্বাচন আরও পেছানোর দাবি নিয়ে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই বলেছে, নির্বাচন আর পেছানো সম্ভব নয়। সে কথা যদি ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলকেও বলে, তাহলে তারা কি করবেন? প্রতিবাদে নির্বাচন বর্জন করবেন? না, সে সুযোগ তাদের নেই। তাদের লক্ষ্য হবে নির্বাচন কমিশনের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করার চেষ্টা করা। বহির্বিশ্বকে জানানো, নির্বাচন কমিশন তাদের দাবি মানছে না। সরকারের প্রতি পক্ষপাতিত্বে দেখাচ্ছে। এই ধরনের ধুয়া তুলে নির্বাচন বানচাল করা না গেলে নির্বাচনে তাদের হার হলে এই বলে চেঁচামেচি শুরু করতে পারবে যে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের জন্য তাদের হার হয়েছে। তারা এই নির্বাচন-ফল মানে না। আমার সহৃদয় পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেই, গত বছরখানেক যাবত বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছেন, এখনই নির্বাচন দিয়ে দেখুন, আপনারা কটা আসন পান? মির্জা ফখরুল প্রকাশ্যে দাবি করেছিলেন ‘এখন নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ ৬০টি আসনের বেশি পাবে না।’’ আমাদের ‘ভঙ্গবীর’ কাদের সিদ্দিকী তো অনবরত প্রেডিকশন দিয়ে চলেছেন, নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ত্রিশটি আসনও পাবে না। তাই যদি হবে, তাহলে নির্বাচনের দিন- তারিখ বদলানোর জন্য (একবার পেছানোর পরও) এই মামার বাড়ির আব্দার কেন? আমার ধারণা, প্রার্থী মনোনয়ন দান ও শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টনের প্রশ্নেই ঐক্যফ্রন্টে গুরুতর সঙ্কট দেখা দেবে। এমনকি ফ্রন্ট ভেঙ্গে যেতে পারে। নির্বাচন বেশিদিন পিছিয়ে গেলে তারা এই ভাঙ্গা তরী মেরামতের সময় পাবে। নইলে তরী ডুবে যাবে। নির্বাচন বেশিদিন পিছিয়ে গেলে। ঐক্যফ্রন্ট তাদের নানা বর্ণের শরিকদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় সময় পাবে মনে করে। আর যদি সে সময় না পায় তাহলে নির্বাচন বানচাল করার জন্য নতুন ষড়যন্ত্র পাকাবারও সময় ও সুযোগ পাবে তারা। এই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যদি নিজেদের অবস্থানে শক্ত থাকে এবং আওয়ামী লীগ-জোটও তাদের ঘর গুছিয়ে স্বাধীনতার শত্রু শিবিরকে মোকাবেলায় একাট্টা হতে পারে, তাহলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি যতই ষড়যন্ত্র করুক, নতুন মুখোশে মাঠে নামুক, স্বাধীনতার পক্ষের শিবিরের এই অপশক্তিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আগামী নির্বাচনে এই অপশক্তির জন্য আরেকবার ইন্নালিল্লাহি পড়ার সুযোগ দেশবাসী পাবেন। আওয়ামী লীগ-জোটের নেতাদের কাছে আমার আজ একটাই অনুরোধ, কঠোর হাতে ঘরের শত্রু সামলান, মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ করুন। বাইরের শত্রুর গোদা পায়ের লাথিকে ভয় করার কিছু নেই। লন্ডন, ১৩ নবেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৮
×