ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ দ্রুত উপশম হওয়া চাই

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৭ অক্টোবর ২০১৮

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ দ্রুত উপশম হওয়া চাই

এম শাহজাহান, বালি থেকে ফিরে ॥ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং এই যুদ্ধের ফলে দেশের রফতানি বাণিজ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হতে পারে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই বাণিজ্যযুদ্ধ দ্রুত উপশম হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্প্রতি বালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভার বিভিন্ন ফোরামে অর্থমন্ত্রী দ্রুত এই বাণিজ্যযুদ্ধ নিরসনের তাগিদ দিয়েছেন। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বার্ষিক সাধারণ সভার বক্তৃতায় জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের চলমান এই বাণিজ্যযুদ্ধের মতো কিছু বাধার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন বেশ ভাল এবং নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে। বৈশিক প্রবৃদ্ধির হার এখন ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ বন্ধ হলে এই প্রবৃদ্ধি আরও ভাল হবে। এদিকে, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশী পোশাকের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আর চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার। অন্যদিকে ১৪ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে চীনের সঙ্গে। এর পরই একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ভারতের সঙ্গে হয়ে থাকে। এই বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জড়িয়ে পড়ছে বাণিজ্য যুদ্ধে। এর ফলে রফতানিকৃত পণ্যের দাম কমে যাওয়া এবং আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অর্থমন্ত্রী এবার বিভিন্ন ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। বাদ পড়েনি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ প্রসঙ্গও। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ আমাদের জন্য নতুন উদ্বেগ। যত দ্রুত এই যুদ্ধ নিরসন হবে, ততই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। কারণ এখান থেকে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্বের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে এই যুদ্ধ। তাই দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধ চলতে থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের এই প্রভাবে দ্রুত বিশ্বে একটি অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের মন্দায় ইউরোপ নয়, এশিয়া আক্রান্ত হবে সবার আগে। এই অবস্থায় মন্দার প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দার প্রভাব নিয়ে এখনই বাংলাদেশের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পণ্য রফতানি ও রেমিটেন্সে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অন্যকে ঘায়েল করতে শুল্ক আরোপের পথ বেঁচে নিয়েছে। এছাড়া ২০১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আটবার সুদহার বাড়িয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। ফলে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মূল্য অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ৯ শতাংশ কমেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত সপ্তাহে মুদ্রানীতি শিথিল করেছে চীন। তবে এরপরও যদি চীনের মুদ্রার দাম পড়ে যায়, তাহলে এশিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলো চীন। তাই যদি চীনের মুদ্রার মান কমে, তাহলে তা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মুদ্রার ওপর চাপ ফেলে। এতে ওইসব দেশের পণ্য চীনা পণ্যের চেয়ে দামী হয়ে পড়ে। আর এটাই ঝুঁকির বিষয়। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভায় আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন লগার্দ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ব্যবসায় নীতি নিয়ে উত্তেজনা ও আমদানি শুল্ক আরোপের কারণে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই দুই পরাশক্তি বিশ্বে একটি খারাপ উদাহরণ তৈরি করছে। আর সেটা হবে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের ঘোষণায় ইতোমধ্যে বিশ^ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে শেয়ার, মুদ্রাসহ আর্থিক বাজার এবং আন্তর্জাতিক পণ্য বাজারেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বাণিজ্যযুদ্ধ যদি নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে ট্যারিফ সুবিধার জন্য দুই দেশই বিকল্প বাজার খুঁজবে। তবে বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশি^কভাবে ছড়িয়ে পড়ে তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের মতো বাণিজ্য নির্ভর দেশগুলোর। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলমান এ যুদ্ধে আরও নতুন নতুন দেশ যুক্ত হতে পারে। ফলে বৈশি^ক বাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চূড়ান্তভাবে সাধারণ ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের তুলা আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে ভারতের তুলার চাহিদা বাড়তে পারে। এর কারণে ভারতের তুলার দাম গত এক মাসের ব্যবধানে বেড়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের বাজারে সুতার দাম বাড়তে শুরু করেছে। ঠিক এভাবে প্রতিটি পণ্যের আমদানি-রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাণিজ্যযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বিশ^বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে। দ্রুত এই যুদ্ধ উপশম হওয়া প্রয়োজন। জানা গেছে, স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার পর বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারানোর একটি ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাজারে আমদানি ও রফতানিতে শুল্কজনিত কোন সমস্যা তৈরি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এমনকি রফতানি কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বাড়তে পারে আমদানিকৃত পণ্যের দাম। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের উপশমের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
×