ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কখনো আমার মাকে...

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কখনো আমার মাকে...

শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি প্রথম যখন পড়ি তখন আমি থাকি গ্রামে। অনন্তপুর আমার গ্রামের নাম। অজপাড়াগাঁ। তখন আমার বয়স কত ছিল মনে নেই। তবে আমি যে তখন স্কুলে পড়তাম তা মনে আছে। আমাদের গ্রামে তখন ইলেট্রিসিটি ছিল না। দিনের শেষ হওয়া আলো আর রাতের সূচিত আঁধারে বৃক্ষের ছায়াঘেরা নির্জনে আমার থাকার ঘরটিকে মনে হতো ভৌতিক এক আবাসভূমি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত যত গভীর হত প্রকৃতিজুড়ে নেমে আসত প্রগাঢ় রহস্যময়তা। অরণ্য আঁধারে প্রেতিনীর কান্না, শেওড়াগাছে ভূত অথবা অশরীরী আত্মার আনাগোনা- সবই ছিল রূপকথার মতো। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় আমার বুক ধুক্ পুক্ করে কাঁপত। মনে হতো, জানালার বাইরে এখনই ভেসে উঠবে ভয়ানক কোন দাঁতাল জন্তুর মুখ। এমনই গা ছমছম করা অবুঝ কৈশোরে আমি পড়েছিলাম শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ কবিতার বইটি। সেই কিশোরবেলায় কোন এক চৈত্রের বিকেলে আমার আব্বা বাজারের লাইব্রেরি থেকে কিছু গল্প-কবিতার বই নিয়ে এসেছিলেন। আমার বড় আপুরা এসব বই পড়তে পছন্দ করতেন। সব বই ছোটদের পড়ার উপযোগী ছিল না। আমি ভূত ভয় পাই বলে আব্বা দুয়েকটা ভৌতিক গল্পের বইও এনেছিলেন। ভূতের ভয় কাটাবার জন্য ভূতের বই পড়া- ব্যাপারটা ছিল খুবই মজার। কিন্তু আমি ভূতের বই পড়তে পছন্দ করতাম না। আপুরা যেসব বই পড়ত আমিও সেই বইগুলো পড়তে চাইতাম। কিন্তু আমাকে পড়তে দেয়া হতো না। বড় আপুকে দেখেছি ‘চিতাবহ্নিমান’ নামের একটি বই পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে। এসব বই পড়লে আমিও কেঁদে ফেলব বলেই কি আমাকে পড়তে দেয়া হয় নি? এমন প্রশ্নই জেগেছিল আমার কৈশোর অনুত্তীর্ণ মনে। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এক রাতে মেঝো আপুর পড়ার টেবিলে পড়ে থাকা কয়েকটি বই থেকে বেছে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ নামের একটি বই আমি হাতে নিলাম। কয়েক পাতা উল্টে ‘কখনও আমার মাকে’ শিরোনামের কবিতাটি চোখে পড়ল। পড়ে ফেললাম এক নিশ^াসে। পড়ার পরই আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। কয়েকবার পড়া হলে আমার কিশোর মনে অদ্ভুত এক ‘দোল’ এর অনুভূতি তৈরি হল এবং সেটি মনের গহীনে এতটাই দোলা দিয়েছিল যে, এর ছন্দ দোলায়মান ছিল বহুক্ষণ, এমনকি বহুদিনও। ব্যস, ওইটুকুই। কবিতাটির নিগূঢ় অর্থ বা এর তাৎপর্য বোঝার মতো জ্ঞান তখনও আমার হয়ে উঠেনি। কিন্তু যখন পড়লাম, ‘কখনো আমার মাকে কোন গান গাইতে শুনিনি’ তখনই কবি আমার আপন মানুষ হয়ে উঠলেন। আরে ঠিকই তো! আমিও তো ‘কখনো আমার মাকে’ কোনদিন গান গাইতে শুনিনি! শুধু ঘরকন্না নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন, রান্না-বান্না করবেন, সন্তান জন্ম দেবেন, লালন-পালন করবেন, সর্বোপরি নিজের অসুখ-বিসুখ উপেক্ষা করে গৃহকর্তা ও সন্তানদের সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেবেনÑ মাকে নিয়ে এমন ধারণা আমাদের চিরকালের। কিন্তু কবিতাটি পড়ার পর একটু আবেগাপ্লুত হয়ে ভেবেছিলাম, কথাগুলো আমার মাকে নিয়ে লেখা। মায়ের এমন একটি ঘরোয়া বিষয় নিয়ে কবি যে পদবাচ্য রচনা করলেন আমাদের মনে রাখা এবং কবিকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখার মতো খোরাক হয়ে গেছে। কবিতাটি পড়তে পড়তে প্রায় প্রতিটি শব্দে, বাক্যে আমি আমার মাকে খুঁজে পেয়েছিলাম অথবা কবির মা-ই হয়ে উঠেছিল আমার মা। যুগে যুগে সেই সব কবি সাহিত্যিকই অমর হয়েছেন, যাঁদের ভাবনানিঃসৃত কথামালা বাণীবদ্ধ হয়ে সকলের ভাবনার সঙ্গে মিলে গিয়েছে। শামসুর রাহমান এই কবিতাটিতে অনুভূতির প্রক্ষেপণে বাঙালী ও বাংলা ভাষার পাঠক হৃদয়ে যে অনভূতির বিস্তার করেছেন এইটুকুই তাঁকে অমর করে রাখতে যথেষ্ট। শামসুর রাহমানের জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কবিতার সঙ্গে লত্কা লত্কি করে। তিনি সেই কথা আমাদের জানিয়েও গেছেন, ‘কাল সারারাত আমি কবিতার সঙ্গে অতিশয়/লত্কা লত্কি করে কাটিয়েছি...।’ তিনি সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে কাব্য রচনা করেছেন অবলীলায়। ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০) গ্রন্থেই তিনি কবিতার সরোবরে রূপালি ¯œানটি সেরে রেখেছিলেন। তারপর পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’। ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’ কবিতায় সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। রচনা করেছেন ‘বন্দিশিবির থেকে’ ‘নিজ বাসভূমে’ ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’ ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ ‘ইকারুসের আকাশ’ ‘অবিরাম জলভ্রমি’ ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’ ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’ অস্ত্রে আমার বিশ^াস নেই’ ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ কাব্যগ্রন্থÑ যেখানে বিম্বিত হয়েছে গণমানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে লিখেছেন, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ নামক কবিতা। সত্তরের নবেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে লিখেছেন, ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ আর ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়ে আছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ‘কখনো আমার মাকে কোন গান গাইতে শুনিনি’ পঙ্িিক্তটি মনে এলে আজও রোমাঞ্চিত হই, হই আবেগে আপ্লুত। চলুন, কবিতাটি আরেকবার পড়ে নেয়া যাক। ‘কখনো আমার মাকে কোন গান গাইতে শুনিনি।’ সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না যখন শরীরে বসন্তের সম্ভার আসেনি, যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোন গান লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়, পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ ছিলেন নিশ্চুপ বড়, বড় বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাকে করেনি দখল কোনদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়, ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোন গান গেয়েছেন কি না এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি। যেন তিনি সব গান দুঃখ জাগানিয়া কোন কাঠের সিন্দুকে। রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!
×