ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কবি-ছবিয়ালের যুগলবন্দী আয়না কাব্য

প্রকাশিত: ০৭:১০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কবি-ছবিয়ালের যুগলবন্দী আয়না কাব্য

আতিকুর রহমান (কমল) আরিফুল ইসলাম অপু। দুই অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু। ছবিয়াল কমল আর কবি অপুর যুগলবন্দী আয়না কাব্য দর্শকের হৃদয় কেড়েছে ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে। বিন্দু বিসর্গে অংশ নেয়া ১২ তরুণের মধ্যে কমল-অপু ব্যতিক্রম একজন ছবিয়াল অপরজন কবি। প্রদর্শনীর প্রজেক্ট বিন্দু বিসর্গের নামটিও নেওয়া হয়েছে। অপুর কবিতা থেকে। ছবিয়ালের ছবির সঙ্গে কবির কবিতা প্রকাশের প্রকাশিত রূপ এই আয়না কাব্য একই দর্শন। দুই তরুণ একে অপরের ভাবনার গভীরে সাঁতরাতে পারেন সহজেই। ছবিয়াল কমলের সঙ্গে কবি অপুর প্রথম দেখা হয় ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে। তখন অবশ্য দু’জনই কবিতা লিখতেন। কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল বন্ধুত্বের। কমল একটি লেখা শেষ করলে সেখানে এসে অপু আরও চারটি লাইন জুড়ে দেয়। একে অপরের ভাবনাকে ছুঁয়ে যায়। উভয়ের কবিতার যুদ্ধ চলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কখনও এক ছন্দে আবার কখনও কবিতার জবাবে কবিতা দিয়ে ভরে উঠত কমেন্টস বক্স। তাদের মধ্যে কথোপকথন চলত কাব্যিক ধারায়। বর্তমানে দু’জনই প্রকৌশলবিদ্যায় অধ্যয়নরত। কমল মেরিনে আর অপু ইলেক্ট্র্রিক্যালে। কমলের বিপরীতে অপু কিন্তু একটু চুপচাপ। নিজের মধ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। গাজীপুরে জন্ম নেয়া অপুর বাবা আজিজুল ইসলাম একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এক ভাই-এক বোনের মধ্যে অপু সবার বড়। অপুর যত খেলা সব শব্দ নিয়ে। তার ভাবনা জুড়ে কেবলই কবিতা। চলার পথে যা দেখেন তার মধ্য থেকে বেছে নেন কবিতার বিষয় তারপর শব্দ সাজানোর পালা। আতিকুর রহমান বাবা আবুল কাশেম একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। মা গৃহিণী। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছোট। মায়ের ইচ্ছা ছিল ছোট ছেলেকে হাফেজি পড়াবেন। বছর খানেক পড়লেনও সেখানে। কিন্তু ওখানকার পরিবেশে কমল যেন নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। অগত্যা চলে এসে যশোর জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে সেখান থেকেই এসএসসি এবং ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০০৭ সালে স্কাউটিংয়ে পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট এ্যাওয়ার্ড। শৈশব থেকেই নিজের পছন্দ অনুযায়ী বেড়ে উঠতে চাওয়া কমল জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে পরিবারের ইচ্ছার দ্বারা চালিত হচ্ছিলেন। যখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র বাবা তখন অবসরে যান। পরিবারের সকলের সঙ্গে বয়সের পার্থক্যে গ্যাপ থাকার কারণে ছোটবেলা থেকেই একাকী বেড়ে উঠেছেন কমল। তার চাওয়াগুলো সহসাই স্থান পায়নি পরিবারের অন্য সবার কাছে। যশোর ছাড়ার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ছাড়তে হওয়ায় বিষয়টি জোর করে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপানোর ফলে আশানুরূপ ফল মিলল না এইচএসসিতে। পরিবারের ইচ্ছা আর ভ্রান্ত ধারণার কারণে চারুকলায় পড়ার ইচ্ছাটার হলো মৃত্যু। নিজস্ব চাওয়ার কাছে বার বার থেমে যাওয়া কমল সে বছর কোথাও এ্যাডমিশন নিলেন না। আবার যশোরে ফেরা। বাবা-মায়ের চাওয়া ছিল ছেলে বড় ভাইয়ের মতো মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হবে। পরিবারের আর নিজের ইচ্ছার সঙ্গে লড়াইয়ে দিশেহারা কমল বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন মেরিনে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে ঘোরাফেরা করে বাসায় চলে আসেন। যেহেতু পরীক্ষাই দেননি তাই রেজাল্ট হওয়ার কথাই নয়। বাবা-মা হাল ছাড়তে রাজি নন। তাকে প্রকৌশলী হতেই হবে। তাই বেসরকারী মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে হলো কমলকে। ইন্টার্নি করতে গেলেন সিঙ্গাপুরে। সেখানে পরিচয় হয় ইঞ্জিন ক্যাডেট ও সোশ্যাল ওয়ার্কার সৈকতের সঙ্গে। যিনি ভাল ফটোগ্রাফি করতেন। তার তোলা দুটো ছবি অনেক বেশি ভাল লেগে যায় কমলের। ইচ্ছে জাগে সুন্দর ছবি তোলার। ইন্টার্নি শেষ করে ২০১৫তে দেশে আসার আগে একটা ভাল ক্যামেরা কিনলেন। মেরিন পড়ার পাশাপাশি চলতে থাকল তার ফটোগ্রাফি। অপরিপক্ব হাতে তোলা ছবি প্রথম প্রদর্শনীতে স্থান পায় ২০১৫ সালে। সিলেক্টেড ৩টি ছবির মধ্যে ১টি করে নেয় চতুর্থ স্থান। বিষয়টি তাকে আশ্চর্যান্বিত ও ফটোগ্রাফির বিষয়ে উৎসাহী করে তোলে। ছবি দেখে বন্ধু ও পরিচিত মহলের কাছ থেকে পাওয়া প্রশংসা, প্রেরণা তাকে ফটোগ্রাফির প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট করে। এরপর দুটি প্রদর্শনীতে ছবি জমা দিয়েও চান্স মিলল না। ‘তবে কি আমার কিছুই হচ্ছে না’Ñ ভাবনায় পড়লেন কমল। ২০১৬তে শিল্পকলায় প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে আবার ছবি জমা দেন এবং তার ছবি গ্র্যান্ড এ্যাওয়ার্ড পায়। ২০১৫ সালে যশোরে থাকাকালীন ইভটিজিংয়ের ওপর একটা ডকুমেন্টারি বানান তিনি। যা বিশ্বজিৎ গোস্বামী স্যারকে দেখানোর পর স্যারের কাছ থেকেও সামনে এগিয়ে চলার উৎসাহ পেয়েছিলেন। একই সঙ্গে চলছে তার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। আবার ‘পাঠশালায়’ বেসিক কোর্সেও নিজেকে যুক্ত করেন। এ কোর্স চলাকালীন সময়ে বিশ্বজিৎ স্যারের কাছ থেকে এবারের এশিয়ানে বিন্দু বিসর্গ প্রজেক্টটি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং থিম নির্ধারণ করেন কমল। কমলের তোলা ছবির সঙ্গে কবিতা নিয়ে প্রস্তুত হয় অপু। বিষয় হিসেবে বেছে নেন নারী জীবনের পর্যায়গুলো। ছয়টি ধাপে দেখাতে চেয়েছেন একটি নারীর জীবনের শুরু থেকে শেষ। এখানে প্রতি ১০ বছরে বিভক্ত করে ছয়টি ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ধাপের গতিময়তা, চঞ্চলতা ছবিতে বোঝনো হয়েছে হাতের পেছনে জলের আলোড়ন দিয়ে। হাতের লাল রঙের চুড়িতে বুঝা যায় যে গল্পটি একটি মেয়ের, এক জীবনের। এক এক সময়ে তার জীবনে যে আসে নারী মন তাকে ঘিরেই সে ধাপটি পাড়ি দেয়। পর্যায়গুলোতে শৈশব পেরিয়ে বড় হয় সে, তারপর বন্ধু, প্রণয়ী, মা, বৃদ্ধ, এবং সবশেষে সময়ের কাছে তার ফুরিয়ে যাওয়া। এর সবই প্রতীকী অর্থে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আয়না কাব্যে , সঙ্গে অপুর কবিতা যেন প্রতিটি ছবিকে দিয়েছে প্রাণ। শূন্য থেকে শুরু, শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া। এটাই মানব জন্মের নিয়তি। অপু যখন লেখেন শূন্যতে শুরু, শূন্যতে শেষ শূন্যের প্রান্তর শূন্যে মিলি শূন্যে মিলাই বিরাণ অন্তর। শূন্যের তরে শূন্য লইয়া শূন্যে বান্ধি ঘর, শূন্যের মাঝে শূন্য হাসে, শূন্যে আপন পর। আজ যে শূন্য জড়ায়ে ধরিয়া মানব জনম হাসে কাল সে শূন্য দূরেতে ঠেলিয়া মৌন সর্বনাশে। তখন তার সঙ্গে এক মত হয়ে বলতে হয় শূন্যে মিলিয়ে যাব আমরা সবাই। কিন্তু মিলিয়ে যাবার আগে এই দুই তরুণের কাছে চাওয়া এই পৃথিবীতে নিজেদের ছাপ রেখে যাওয়ার মতো কিছু করে যাওয়ার। আমাদের বিশ্বাস তাদের দু’জনের যুগলবন্দীতে সেটা সম্ভব।
×