ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

সোনালি সম্পর্কের প্রতীক ॥ ভারত থেকে আরও ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সোনালি সম্পর্কের প্রতীক ॥ ভারত থেকে আরও ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারত থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার বিকেলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দিল্লী এবং ঢাকা থেকে বিদ্যুত আমদানি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আগরতলা থেকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব যোগ দেন। এ সময় আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেললাইন প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশ এবং মৌলবীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধন হয়। নরেন্দ্র মোদি ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি মেগাওয়াট থেকে গিগাওয়াটে উন্নীত হওয়ার এই মুহূর্তকে দুই দেশের সম্পর্কের সোনালী প্রতীক বলে অভিহিত করেছেন। মোদি বলেছেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত বাংলাদেশে রফতানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আগে বাংলাদেশে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত রফতানি করত ভারত এখন এই পরিমাণ এক দশমিক ছয় গিগাওয়াটে উন্নীত হলো। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত রফতানিতে মোদির সহায়তা চান। হাসিনা বলেন, ভারত থেকে আমরা আরও তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করতে যাচ্ছি। বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু দেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে আরও বিদ্যুত প্রয়োজন। এজন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পশ্চিমবাংলা বাংলাদেশকে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত দিতে সম্মত রয়েছে। এর আগেই শেখ হাসিনাকে তার এই আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করে মমতা বলেন, এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। কেন্দ্র অনুমোদন দিলে পশ্চিমবাংলা এই বিদ্যুত দিতে প্রস্তুত রয়েছে। সোমবার বিকেল ঢাকার স্থানীয় সময় পৌনে ৫টায় বিদ্যুত আমদানির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও দিনের প্রথম প্রহর অর্থাৎ রবিবার রাত ১২টা থেকে বিদ্যুত সরবরাহ শুরু করেছে ভারত। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির আওতায় ভারত থেকে এই বিদ্যুত আমদানি করছে। প্রসঙ্গত ২০১৩ সালে ভারত থেকে প্রথম ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি শুরু হয়। এজন্য ভেড়ামারা এবং বহরামপুরে ব্যাক টু ব্যাক সাবস্টেশন নির্মাণ করা হয়। প্রথম সাবস্টেশনটির ক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। এখন একই জায়গাতে সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় আরেকটি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে ওই সাবস্টেশনটির উদ্বোধন করা হলো। দ্বিতীয় সাবস্টেশন দিয়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হবে। এরপর ত্রিপুরা থেকে আরও ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হচ্ছে। দেশের কুমিল্লা দিয়ে এই বিদ্যুত আসছে। স্বল্প মেয়াদে ৩০০ ও ২০০ মেগাওয়াট করে ভারতের দুটি কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুত কেনা হচ্ছে। সরকার স্বল্প এবং দীর্ঘ দুই মেয়াদে বিদ্যুত ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বল্প মেয়াদে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। দীর্ঘ মেয়াদে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩৩’র ৩১ মে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এনভিভিএন (ইন্ডিয়া) থেকে স্বল্প মেয়াদে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৭১ পয়সা দরে দৈনিক ৩০০ মেগাওয়াট এবং পিটিসি ইন্ডিয়া থেকে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৮৬ পয়সা দরে দৈনিক ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হবে। আর দীর্ঘ মেয়দে এনভিভিএন প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৪৮ পয়সা মূল্যে ৩০০ মেগাওয়াট এবং পিটিসি থেকে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৫৪ পয়সা মূল্যে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হবে। উদ্বোধন হওয়া আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প এবং কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল পুনর্বাসন প্রকল্পের খরচের একটি বড় অংশ মেটানো হবে ভারতের এক বিলিয়ন ডলার ঋণের অংশ থেকে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে ত্রিপুরার আগরতলা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পের ৪৭৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ের মধ্যে ভারত সরকার ঋণ হিসেবে দেবে ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বাকি ৫৭ কোটি ৫ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারই যোগাবে। রেলপথের পাশাপাশি কালভার্ট, প্যাসেঞ্জার প্ল্যাটফর্ম, প্ল্যাটফর্ম শেড, কাস্টমস এ্যান্ড ইমিগ্রেশন ভবন এবং পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের রেল যোগাযোগ সহজ হবে। রেলপথে ত্রিপুরা থেকে কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৬৫০ কিলোমিটার থেকে কমে দ৭াড়াবে ৫১৫ কিলোমিটারে। অন্যদিকে আখাউড়া থেকে শাহবাজপুরের মধ্যে ৫৩ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন কাজে ব্যয় হবে ৬৭৮ কোটি ৫০ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। প্রকল্পটিতে ভারতীয় ঋণ থেকে পাওয়া যাবে ৫৫৫ কোটি ৯৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা; আর ১২২ কোটি ৫২ লাখ ৩ হাজার টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের অধীনে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথে রেলসেতু, স্টেশন ভবন, প্ল্যাটফর্ম, রেললাইন এবং অন্যান্য রেল অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক বিশ্বের অন্যান্য অংশের জন্য রোল মডেল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বহু বছর ধরে আমাদের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ এবং সুনামের কারণে আমাদের সম্পর্ক পরিপক্বতা পেয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের এ সম্পর্ক বিশ্বের অন্যান্য অংশের জন্য একটি রোল মডেল হয়ে উঠেছে। এই সুসম্পর্ক আমাদের দৃঢ় আস্থার সঙ্গে পারস্পরিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও সেদেশের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে আমরা সব সময়ই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। এটি আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরদিনই একটি মাইলফলক হিসেবে বজায় থাকবে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদ্যুত ও জ্বালানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দু’দেশের মধ্যে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ব্লু ইকোনমি, সামুদ্রিক সহযোগিতা, পারমাণবিক শক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ গবেষণার মতো নতুন নতুন ক্ষেত্রেও কাজ আমরা শুরু করেছি। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি বর্তমানে রেলওয়ে খাতে আমাদের দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশের ও ভারতের মধ্যে মালামাল পরিবহনের জন্য আমরা ১৯৬৫-পূর্ব রেল সংযোগ পুনরায় চালু করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা শীঘ্রই লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ভারতীয় অর্থায়নে যৌথভাবে ঢাকা ও টঙ্গীর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং টঙ্গী ও জয়দেবপুরের মধ্যে ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণের ভিত্তিফলক স্থাপন করতে পারব। বিদ্যুত উন্নয়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুত খাত আমাদের দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্তমানে ভারত থেকে আমরা ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করছি। ভারত থেকে আরও তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা গত সাড়ে ৯ বছরে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট থেকে ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশের উন্নয়নে সমর্থন দেয়ার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বক্তব্যের শুরুতে বাংলায় শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, সকলকে বিশেষভাবে বাংলাদেশের ভাই ও বোনেরা নমস্কার গ্রহণ করুন। নতুন প্রকল্পের উদ্বোধন আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের নতুন মাত্রা। যা ভবিষ্যতে আরও সুদৃঢ় হবে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের বন্ধনে কোন প্রটোকল মানে না। সম্পর্ক সর্বোচ্চ মানে থাকবে। রেললাইন প্রকল্প এ সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। মোদি বলেন, বাংলাদেশ মধ্য আয় এবং ২০৪১ এর মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে। এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবে ভারত। ভিডিও কনফারেন্সে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ছাড়াও দুই দেশের সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। ভারতের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এবং পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। পরে বিদ্যুত বিভাগের সচিব এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের ওপর দুটি উপস্থাপনায় বিভিন্ন অগ্রগতি তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী এরপর ভেড়ামারা, কুলাউড়া এবং আখাউড়ার সঙ্গে সংযুক্ত হন। এ সময় তিনি স্থানীয় উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন।
×