ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১০ আগস্ট ২০১৮

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ চমৎকার একটি প্রতিবাদ দেখল শহর ঢাকা। এইটুকুন বাচ্চারা, যাদের মুখে তুলে খাওয়াতে হয়, সেই তারা নিজ দায়িত্বে নেমে এলো রাস্তায়। ঘাতক বাস প্রাণ কেড়ে নিয়েছে দুই সহপাঠীর। মানতে পারল না। সংগঠিত হয়ে বিচার চাইল তারা। নিরাপদ সড়কের দাবি জানাল জোরেশোরে। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিল ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েরা। ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস ইত্যাদি পরীক্ষা করল। হঠাৎ কা-ে দুর্ভোগ বেড়ে কয়েকগুণ হলো। এরপরও সাধারণ মানুষ আন্দোলনকে স্বাগত জানাতে কার্পণ্য করেননি। দারুণ ব্যাপার এই যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাচ্চাদের চাওয়াগুলোর যতœ করেছেন। যৌক্তিক বলে গ্রহণ করে নিয়েছেন। কিছু দাবি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূরণ করেছেন তিনি। বাকি দাবিগুলো ক্রমে পূরণ করা হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। আন্দোলকারীরাও যে যার স্কুল-কলেজে ফিরে গেছে। মন দিয়েছে লেখাপড়ায়। শহর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। সচেতন মানুষ বলছেন, শিক্ষার্থীরা সড়কের নানা সমস্যাকে সামনে এনেছে। তুলে ধরতে পেরেছে। এখন সমাধানের জন্য আন্তরিক উদ্যোগ চাই। পুরনো চোখে দেখলে চলবে না। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর অধিদফতরগুলোকে একটু গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। চোখ ধুয়ে নতুন করে শুরু করতে বলছেন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে যে জনসমর্থন তা কাজে লাগিয়ে অনেক অসম্ভব সম্ভব করা যায়। সেটি প্রধানমন্ত্রী করে দেখাবেন, আশা করছেন ঢাকাবাসী। অবশ্য দুষ্টু লোকেরাও বসে নেই। বসে ছিল না। তাদের লক্ষ্য অন্য। স্কুল-কলেজের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আন্দোলনে ঢুকে পড়েছিল বড় ভূত চেনা পেতিœরা। তারা কোমলমতিদের চাওয়ায় যে সারল্য, যে সৌন্দর্য ছিল তৃতীয় পক্ষ সেটি নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। এখনও তারা বসে নেই। নানা ফন্দি করছে। করছে যে, নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তা বোঝা যাচ্ছে। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতারা চকোলেট ফুল দিয়ে আন্দোলনরতদের পাশে ছিলেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তারা বাড়াবাড়ি করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। সব পক্ষকেই মূল চাওয়াটিতে ফিরতে হবে। গুজবে কান দিলে চলবে না। ফাঁদে পা দিলে থেমে যাবে পথচলা। এ অবস্থায় শহর ঢাকার মানুষ আন্দোলনের স্পিরিটটি কাজে লাগানোর ওপর জোর দিচ্ছেন। গত সপ্তাহে বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। অবশ্য কিছু ভাল ছবি এখন রাস্তায় নামলে দেখা যাচ্ছে। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ইতোমধ্যে ট্রাফিক সপ্তাহ ঘোষণা করে রাস্তায় নেমে এসেছেন বড় বড় কর্মকর্তারা। প্রতিদিনই প্রচুর মামলা দেয়ার খবর আসছে। সেই সঙ্গে পথচারীদের ওভারব্রিজ জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারে উদ্বুব্ধ করা হচ্ছে। না, কেবল ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরাই নন। এ কাজে এগিয়ে এসেছেন রোভার স্কাউট ও গার্লস গাইডের সদস্যরা। দৃশ্যটা দেখার মতো। সুন্দর। নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় নিজেদের পোশাক গায়ে কাজ করছেন তারা। সকলেই শিক্ষার্থী। কিন্তু দায়বোধ আছে। তাই রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সড়কে যানবাহনের শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজ করছেন। রাস্তা পারাপারে পথচারীদের সহযোগিতা করছেন। ট্রাফিক আইন মেনে কেউ তেমন অভ্যস্থ নন। অবাধ্যদের তাই বলেকয়ে বুঝিয়ে বাধ্য করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। বিজয় সরণি, শাহবাগ, শাপলা চত্বর, হাইকোর্ট মোড়, সোনারগাঁও মোড়, মহাখালী, ধানম-িসহ ৮ পয়েন্টে দেখা যাচ্ছে তাদের। বুধবার শাহবাগ মোড়ে বেশকিছু সময় দাঁড়িয়ে, সত্যি বলতে কী মন ভরে গেল। এখানে কাজ করছিলেন ঈগল ওপেন স্কাউট গ্রুপের সদস্যরা। কয়েক তরুণ-তরুণী। সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলেন। নূর জাহান আক্তার পল্লবী, মাহমুদুল হাসান তালুকদার, শারমিন আক্তার, তাসলিমা আক্তার সুমি, আবুল কালাম আজাদসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা। একটি কথা খুব বাস্তব বলে মনে হলো। গ্রুপের একজন কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলছিলেন, ‘ভাই, এ দেশের রাস্তা খারাপ। ট্রাফিক পুলিশ খারাপ। সরকার ভাল না। ভাল শুধু জনগণ!’ চট করে কথাটির মানে বোঝা যায় না। তবে না বোঝারও কিছু নেই। তিনি বলতে চাইছিলেন, সাধারণ মানুষ ট্রাফিক আইন মেনে অভ্যস্ত নন। শিক্ষিত লেখাপড়া জানা মানুষ ফুট ওভারব্রিজ বুঝেন না। জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করা শেখেননি। এমনকি কেউ কেউ আইন মানতে বললে তেড়ে আসেন। তবে এতকিছুর পরও তারা হতাশ নন। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এ চেষ্টা থেকে আসলেই তো সরে আসার কোন সুযোগ নেই। আর একটি প্রসঙ্গ টেনে শেষ করা যাক। কুর্মিটোলার শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী যেখানে বাসের চাপায় পিষ্ট হয়েছিল, সেখানে জেব্রা ক্রসিং ও স্পিডব্রেকার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। কাজটি করছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। পর্যায়ক্রমে সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে জেব্রা ক্রসিং ও স্পিডব্রেকার নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। পাশাপাশি যেসব স্থানে জেব্রা ক্রসিংয়ের রং নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো নতুন করে রং করা হবে। এর আগে রমিজ উদ্দিন কলেজে কয়েকটি বাস উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সব মিলিয়ে পরিবর্তনের হাওয়া। এই হাওয়া গতি পাক। সড়ক হোক নিরাপদ।
×