ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্রোয়েশিয়া ‘নতুন’ ও নবম, না ‘ব্যর্থ’ ও পঞ্চম হবে

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১৩ জুলাই ২০১৮

ক্রোয়েশিয়া ‘নতুন’ ও নবম, না ‘ব্যর্থ’ ও পঞ্চম হবে

রুমেল খান ॥ ‘আমি ফুটবল/নই নিশ্চল/আমায় নিয়ে কত কোলাহল/করে দুই দল/কত হৈ চৈ/সবার স্পর্শে ধন্য হই/বিশ্বকাপে হই আরও ধন্য/নয়তো তাই নগণ্য/সবার কাছে আমি কতই না আপন/লাথি খেয়েই সার্থক এ জীবন!’ এ ক্রীড়াভুবনের ক্রীড়ামঞ্চে অসংখ্য ক্রীড়ার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়া হচ্ছে ফুটবল। জাতিসংঘের অধীনে যত দেশ আছে, তারচেয়ে বেশি দেশ আছে ফিফার অধীনে। ফুটবল খেলা নিয়ে যেমন কুরুক্ষেত্র বেধে যায়, তেমনি থেমে যায় যুদ্ধও। এ খেলাটিতে কি এমন আছে যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচ্ছন্ন করে রাখে সবাইকে? এর উত্তর দেয়া মুশকিল। তবে এটা নিশ্চয়ই বলা যায়Ñ একটি চর্মগোলকের মহাযজ্ঞ যেন মানুষের এক জীবনের সব আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সার্থক প্রতিচ্ছবি। দু’দলের মধ্যে লড়াইয়ের আগে প্রচুর বিশ্লেষণ, ভবিষ্যদ্বাণী, তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা, এমনকি মারামারিও হয়ে থাকে। সবমিলিয়ে এ জন্যই এই খেলাটি আরও বেশি ইন্টারেস্টিং। এই সূত্র মেনেই রাশিয়া বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ম্যাচটিও বেশ ইন্টারেস্টিং হয়েছে। যাতে ক্রোয়েশিয়া ২-১ গোলে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। অনেক হিসেব-নিকেশ আর ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে এই খেলায়। আবার দু’একটি সত্যিও হয়েছে। যেমন : আমিরাতের বিখ্যাত গণক-উট ‘শাহীন’ এই ম্যাচের আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল ‘দ্য ব্লেজার্স’ খ্যাত ক্রোয়েশিয়াই জিতবে। সেটাই হয়েছে। তবে এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি ‘থ্রি লায়ন্স’ খ্যাত ইংল্যান্ড। কেননা তারা আস্থা রেখেছিল চুনেত চাকিরের ওপর। কেন? কারণ তুরস্কের এই রেফারি পরিচালনায় এর আগে কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচে (৫ ম্যাচে) হারেনি ইংল্যান্ড। কিন্তু ষষ্ঠ ম্যাচে চুনেত থাকার পরও হার এড়াতে পারেনি ইংল্যান্ড। কাজেই চুনেত থাকলেই ইংল্যান্ড ম্যাচ জেতেÑ এই থিওরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দারুণ একটি কীর্তি গড়েছে ক্রোয়েশিয়া। তারা দ্বিতীয় সর্বক্ষুদ্র আয়তনের দেশ এবং দ্বিতীয় সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে ক্রোয়েশিয়ার অবস্থান ১২৪ নম্বরে। দেশটির আয়তন ৫৬,৫৯৪ স্কয়ার কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে আয়তনে আরও ছোট তিনবার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা নেদারল্যান্ডস (১৩১ নম্বরে) এগিয়ে আছে ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে। নেদারল্যান্ডসের আয়তন ৪১,৮৫০ স্কয়ার কিলোমিটার। জনসংখ্যায় ক্রোয়েশিয়া আছে বিশ্বের মধ্যে ১২৮ নম্বরে। তাদের চেয়ে কম জনসংখ্যা ১৩৩ নম্বরে থাকা দু’বার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে দু’বারই চ্যাম্পিয়ন হওয়া লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ের জনসংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। আরেকটি রেকর্ড গড়েছে ক্রোয়েশিয়া। বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় দল হিসেবে টানা তিনটি ১২০ মিনিটের ম্যাচ খেলেছে তারা। এর আগের কীর্তিটি ইংল্যান্ডেরই। এর আগে ১৯৯০ আসরে তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে বেলজিয়াম, কোয়ার্টারে ক্যামেরুন এবং সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে খেলেছিল। এবার ক্রোয়েশিয়াও তাই করেছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ডেনমার্ক, কোয়ার্টারে রাশিয়া এবং সেমিতে ইংল্যান্ডকে হারায় তারা। এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে আছে ক্রোয়েশিয়া। যেখানে তারা তিনটি ম্যাচেই জিতেছে, সেখানে ১৯৯০ সালে শেষ ম্যাচটি হেরেছিল ইংল্যান্ড। অনেকেই আবার ক্রোয়েশিয়াকে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আগেভাগেই ধরে নিয়ে একটু বেশিই ভেবে ফেলে আরেকটি সমীকরণও সামনে এনেছেন। সেটা হলো : ২০১৮ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ক্রোয়েশিয়া নিশ্চিতভাবেই বাদ পড়বে ২০২২ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই। সেটা কিভাবে? গত তিন বিশ্বকাপের সূত্র ধরে। যেমন ২০০৬ আসরের চ্যাম্পিয়ন ইতালি ২০১০, ২০১০ আসরের চ্যাম্পিয়ন স্পেন ২০১৪ এবং ২০১৪ আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি ২০১৮ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়েছে। কাজেই ২০১৮ আসরে ক্রোয়েশিয়া চ্যাম্পিয়ন হলে তারা যে ২০২২ আসরের প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়বে সেটা তো জানা কথাই। বিশ্বকাপ ফুটবলে আগের ২০ আসরে শিরোপা জিতেছে আটটি দেশ। এগুলো হলো : আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং স্পেন। সেমিতে বেলজিয়াম বিদায় নেয়ার পর এবং ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে ওঠায় নবম ও নতুন দেশ হিসেবে কোন দেশের বিশ্বকাপ ট্রফি জেতার স্বপ্নটা বেঁচে থাকল ক্রোয়েটদের। তবে ফাইনালে জিততে না পারলে পঞ্চম দল হিসেবে ক্রোয়েশিয়া যোগ দেবে আগের চারটি ‘ব্যর্থ’ দেশের তালিকায়। এই তালিকায় আছে হাঙ্গেরি, সুইডেন, চেক প্রজাতন্ত্র ও হল্যান্ড। এই দেশগুলো রানার্সআপ হলেও কখনই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায়নি। ১৯৩৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল সাবেক চেকোসেøাভাকিয়া (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র) ইতালির কাছে ২-১, ১৯৬২ আসরে ব্রাজিলের কাছে ৩-১ গোলে হারে। হাঙ্গেরি ১৯৩৮ আসরের ফাইনালে ইতালির কাছে ৪-২ এবং ১৯৫৪ আসরে পশ্চিম জার্মানির (বর্তমানে জার্মানি) কাছে ৩-২ গোলে হারে। হল্যান্ডের কষ্টটা আরও বেশি। তারাই একমাত্র দল যারা সর্বাধিক তিনবার ফাইনালে ওঠেও শিরোপা জিততে পারেনি। তারা ১৯৭৪ আসরে পশ্চিম জার্মানির কাছে ২-১, ১৯৭৮ আসরে আর্জেন্টিনার কাছে ৩-১ এবং ২০১০ আসরে স্পেনের কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল। সুইডেন ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ৫-২ গোলে হার মেনেছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রবিবারের ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে কী নতুন ও নবম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার নজির গড়তে পারবেন মডরিচরা? নাকি হেরে গিয়ে ফাইনালে হারা ব্যর্থ ও পঞ্চম দল হিসেবে অগৌরবের কীর্তি গড়বেন?
×