ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফণীমনসা

নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়- অনাদরে বেড়ে ওঠে, ফুল ফোটে

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২৩ জুন ২০১৮

নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়- অনাদরে বেড়ে ওঠে, ফুল ফোটে

সমুদ্র হক ॥ ফণীমনসা। নাম শুনলে শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আবার সাপের সঙ্গে অন্তমিল খুঁজে পাওয়া যায়। মনসামঙ্গল কাব্যের সাপের ফণার চিত্র ভেসে আসে কল্পনায়। পৌরাণিক উপাখ্যানে মনসা দেবী বেহুলার বর লখিন্দরকে দংশন করেছিল। ফণিমনসা দেখলে সেই কথাও মনে আসে। তবে ফণিমনসা একটি উদ্ভিদ। তিন ধরনের উদ্ভিদ আছে স্থলজ, জলজ ও মরুজ। ফণীমনসা একেবারে শেষের ক্যাটাগরির। দেশ মরু প্রকৃতির মতো নয়। তারপরও ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে ফণীমনসা এই দেশে জন্মায় এবং সেই গাছে হলদেটে ফুলও ফোটে। ফণিমনসার ফুলের কদর নেই বললেই চলে। বলা যায় অনাদরেই বেড়ে ওঠে। কে আর লম্বা ও অধিক কাঁটাযুক্ত এই গাছ লাগায়। একটা সময় গ্রামাঞ্চলে বসতভিটা ও জমির সীমানা দেয়া হতো এই গাছ রোপণ করে। ফল ফলাদির বাগানের সীমানাতেও ব্যবহার হতো। যাতে কাঁটার ভয়ে কেউ সহজে ঢুকতে না পারে। ফণীমনসা ক্যাকটাস বংশদ্ভূত গাছ। বিশে^ ক্যাকটাসের অন্তত ১শ’ ২৭ জাতের সন্ধান পেয়েছে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা; যার স্পেসিস বা বংশ রয়েছে ১ হাজার ৭শ’ ৫০টি। বেশিরভাগ বংশই অজানা। কখন, কোথায়, কিভাবে যে এই ক্যাকটাসের স্পেসিস জন্মাচ্ছে তা অধরাই থেকে যায়। হালে অনেক বৃক্ষ ও পুষ্পপ্রেমী নানা জাতের ক্যাকটাস টবে লাগিয়ে ঘরকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলছে। অনেক ক্যাকটাস বৃক্ষ প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। এই সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়ে মানবকুল তা ঘরের ভেতরে নিয়ে এসেছে। ফণীমনসা ক্যাকটাস বংশোদ্ভূত জি-৮৭৮০ বর্গের উদ্ভিদ। এটি জেরোফাইট প্লান্ট। বিজ্ঞান নাম ‘অপুনিটিয়া ডিলেনিল’। পরিবারের নাম লাতিন ভাষায় ক্যাক্ট। বাংলাদেশে ফণিমনসার জাতগুলোর মধ্যে আছে কেবিনেলিফেরা, মনকাঁটা, নাইগ্লকান্স এবং ওপানসিয়া। মরুজ পরিবেশে এই গাছ বেশি জন্মায়। যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত এবং মাটিতে পানির পরিমাণ কম সেই অঞ্চলে ফণীমনসা বেশি দেখা যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমিতে (বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের সব জেলা বরেন্দ্রভূমির আওতা পড়েছে) ফণীমনসা বেড় উঠছে অনেকটা অনাদরে। ধারালো ও তীক্ষè কাঁটা থাকার পরও ফণীমনসা সহজে কেউ কাটে না। ফণীমনসার কাঁটা নিয়ে অনেক কথা আছে। এত কাঁটা কি করে হয়! বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গাছের কা- পাতার কাজ করে। পাতা ঝরে পড়ার সময় ছোট ও পুরু হয়ে কাঁটায় রূপান্তরিত হয়। রং হয় সবুজ। এই গাছের সালোকসংশ্লেষণ হয় কা- থেকে। সম্পূরক উদ্ভিদে হলদেটে ফুল ফোটে। তাবে তা কালেভদ্রে। ফণীমনসার মূল এতটাই সুগঠিত যে সামান্য বৃষ্টির পানি শোষণ করে। চ্যাপ্টা পাতা ও কা- রসালো ও সবুজ থাকে। পাতা বা কাঁটায় লুক্কায়িত কিছু রাসায়নিক থাকায় স্পঞ্জের মতো নরম হয়। পানির বাষ্পায়ন ও নির্গমন কম। এর কা- পাতার মেকানিক্যাল ও পরিবহন টিস্যু বহুস্তরের সুগঠিত হওয়ায় খরায় নেতিয়ে পড়ে না। সবুজ রঙের কোন পরিবর্তন হয় না। প্রস্বেদনের হার খুব কম। এর এনজাইম ক্রিয়া কিছুটা কম থাকায় উদ্ভিদের বৃদ্ধি ধীরগতি। বর্ষজীবী এই উদ্ভিদ সামান্য বৃষ্টির পর অতি অল্প সময়ে জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। যে কারণে অনেকে এই কাঁটা বৃক্ষকেও এভারগ্রীন বলে। ক্যাকটাস গোষ্ঠীর আরেকটি গাছের নাম ঘৃতকুমারী। বিজ্ঞান নাম এ্যালোয়ি বারবানডেনসিস। দেখতে অনেকটা ফণীমনসার মতো। ঘৃতকুমারীর সবুজ কা- পাতা নরম হওয়ায় এর ভেতরের আঁঠালো রস ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকগণ বলছেন, এ ধরনের উদ্ভিদের পাতা ও রস চিবিয়ে অথবা পান করার আগে ভেষজ গুণাগুণ ভালভাবে জেনে নেয়া দরকার। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে পাশর্প্রতিক্রিয়ায় শরীরের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। ফণীমনসা বা ক্যাকটি গোষ্ঠীর বেশিরভাগ উদ্ভিদের আদি নিবাস আফ্রিকা। প্রাচীন আমলে এই উপমহাদেশে প্রথম এই গাছ দেখা যায় শ্রীলঙ্কায়। ক্যাকটাস বংশোদ্ভূত ক্যাকটি এ্যান্ড সাকুলেন্ট গ্রুপের একটি গাছে ফোটে ‘নাইট কুইন’ নামের একটি ফুল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে ক্যাকটাস গাছে নাইট কুইন ফুল এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে ফুলের নামের কাছে ক্যাকটাস গাছটির নাম হারিয়ে যায়। ক্যাকটাস বংশদ্ভূত ফণীমনসার ফুল এখনও জনপ্রিয়তা পায়নি। যদিও এই ফুলটিকে খুব কম দেখা যায়। বনে ও ঝোপজঙ্গলে ফুটে অনাদরেই ঝরে যায়। কে আর খবর রাখে ফণীমনসা ও তার ফুলের।
×