স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ ব্লগার শাহজাহান বাচ্চুর হত্যার নেপথ্যে এখন দুটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ধর্মবিরোধী লেখার কারণে হামলা? নাকি পারিবারিক কলহ? এই দুই প্রশ্নের উত্তরের জন্য রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের চারটি ইউনিট কাজ করছে। তবে প্রথম দিনে আরও দুটি লক্ষ্য ছিল। তৃতীয়টি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও চতুর্থটি বংশ বিরোধ। তবে এই দুটির সমাধান পেয়েছে তদন্তকারীরা। বুধবারও এই তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করছে। নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। খোঁজ নিচ্ছে হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে। এর পেছনে আসলে কারা জড়িত তাও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল পিপিএম জানান, জেলা পুলিশের পাশাপাশি এখন এটিইউ, সিপিটিসি, পুলিশ হেড কোয়ার্টারের এলআইসি, টিবিআই ইন্টিলিজেন্স এবং র্যাব ইন্টিলিজেন্স কাজ করছে। তিনি জানান, খুব শীঘ্রই হত্যার সঠিক কারণ উদঘাটিত হবে।
পুলিশ সুপার বলেন, শাহজাহান বাচ্চুর পিতা ’৭১ সালে ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। আর বড় ভাই ছিলেন শান্তি কমিটির সোলজার। পরে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পরপরই বাচ্চুর বড় ভাইকে হত্যা করে। এসব নানা কারণে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পরিবারটিকে স্থানীয়রা ভাল চোখে দেখে না। এসব নানা কারণেই এলাকার লোকজনের সঙ্গে তার তেমন কোন ভাল সম্পর্ক ছিল না। শুধুমাত্র স্থানীয় আনোয়ার হোসেন আনুর সঙ্গেই সময় কাটাতেন বেশি।
এসপি জানান, শাহজাহান বাচ্চু ২০১৫ সাল থেকে টুকটাক ব্লগে লেখেন। তবে তার লেখার মানও নিচু পর্যায়ের। তার লেখা দেখলেই তা বোঝা যায়। ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। পারিবারিক বিষয় সম্পর্কে পুলিশ সুপার বলেন, বাচ্চুর দুই স্ত্রী। এই দুই পরিবারের নানা বিরোধের ঘটনা রয়েছে। প্রথম পক্ষের স্ত্রী ঢাকায় থাকেন। সেখানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। এই ঘরে দুটি কন্যা রয়েছে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কাকালদিতে বসবাস করেন। এই ঘরে এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বড় স্ত্রী ঢাকার বাড়ি দখল করে রেখেছে। এই নিয়ে ছোট স্ত্রীর মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। পরে বাচ্চু আবার পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় তার একটি বাড়ি ছিল। সেই বাড়িটি বিক্রি করে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। আর সেই বাড়ি বিক্রির ৮ লাখ টাকা ছোট স্ত্রীকে দেয়ার কারণে বড় স্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়। এসব নিয়ে ক্ষোভ ছিল দু’পক্ষের মধ্যে।
এসপি বলেন, বাড়িতে পরিবারের সঙ্গেও তার খুব যে ভাল সম্পর্ক ছিল তা বলা যাবে না। সে থাকতেন ঘরের স্টোর রুমে। সেখানেই বন্ধু আনোয়ারের সঙ্গে সময় কাটাতেন।
তিনি বলেন, আসলে কী কারণে এই হত্যাকা- ঘটেছে তা শীঘ্রই স্পষ্ট হবে। তবে জঙ্গীবাদীদের হামলাকেও এখনই উড়িয়ে দেয়া যাবে না। এই দুটি দিকেই গভীরভাবে তদন্ত চলছে। মঙ্গলবার দিনভর এই তদন্তে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন) মোঃ আসাদুজ্জামান বিপিএম। এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্তকালে আসা তার পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর করেন।
পুলিশ সুপার আরও জানান, হত্যাকা-ের সময় একজন ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করে ফিরছিলেন। এই সময় তিনি একটি গুলির শব্দ পান। এর কিছু সময় পরেই দুটি মোটরসাইকেলে করে চার যুবক যাচ্ছিল। পুলিশের পোশাক দেখে তারা আতঙ্কে উঠে এবং আক্রমণাত্মক হয়। এই সময় বসে পরে এই পুলিশ সদস্য সেফ করার চেষ্টা করে। তাৎক্ষণিক ঘটনাটি তিনি পুলিশ স্টেশনকে জানান, এরপরই পুলিশ চারদিকে পথগুলোতে চেক পোস্ট বসায়। কিন্তু হামলাকারীদের ধরা যায়নি। তারা হয়ত কোন লিঙ্ক রোডে গিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। দুই মোটরসাইকেলে চার যুবক ছিল। দু’জনের হেলমেট পরা ছিল। কারও মুখেই দাড়ি বা টুপি ছিল না। স্মার্ট ভাবের এই চার যুবক কে? তাদের নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
তদন্তে সঙ্গে থাকা একটি ইউনিটের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, শাহজাহান বাচ্চুর ধর্মবিরোধী পোস্টের ক্ষেত্রে যে হুমকি ছিল সে তা পুলিশকে অবগত করেনি। স্থানীয় পুলিশকে কোনভাবে বিষয়টি অবগত করা হলেও এ রকম বিষয়টি নাও ঘটতে পারত। এই হামলার সঙ্গে ‘আনসারুল ইসলাম’ নামের সংগঠনটি জড়িত থাকার বিষয়েও সন্দেহ পোষণ করেছেন।
পরিবারের সন্দেহ জঙ্গীদের দিকে ॥ ব্লগার শাহজাহান বাচ্চু হত্যাকা-ের ঘটনায় পরিবারের ধারণা অনুযায়ী সন্দেহের তীর এখন উগ্রপন্থী জঙ্গীদের দিকে। তবে আলোচিত এই হত্যাকা-ের কোন ক্লু-উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, উগ্রপন্থী জঙ্গীরা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সে পথেই হত্যাকা-ের ক্লু-উদঘাটনে এগুচ্ছে।
জেলার সিরাজদিখান উপজেলার কাকালদী গ্রামের প্রয়াত মমতাজ উদ্দিনের ছেলে শাহজাহান বাচ্চু কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।