ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ভারতীয় কপ্টার ও ট্যাঙ্ক বাংলাদেশে

জল ও আকাশপথে দুঃসাহসী অভিযানের স্মৃতি, অমূল্য স্মারক

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

জল ও আকাশপথে দুঃসাহসী অভিযানের স্মৃতি, অমূল্য স্মারক

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর লড়াই। মুক্তির সংগ্রাম। এগিয়ে এলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিল। গ্রামের নিরীহ কৃষক, কারখানার সাধারণ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধ লড়ার জন্য প্রস্তুত করল। পরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ হলো মিত্রবাহিনী। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ভারতীয় সৈন্যরা প্রবেশ করল বাংলাদেশে। সেইসব অস্ত্র, যুদ্ধ সরঞ্জাম এখন মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য স্মারক। একাত্তরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ধারণ করে আছে। সঙ্গত কারণেই ভারত এসব স্মৃতিনিদর্শন যতেœর সঙ্গে সংরক্ষণ করছে। বিশাল সংগ্রহ থেকে প্রীতি উপহার হয়ে কিছু আসছে বাংলাদেশেও। বিগত দিনের দেয়া নেয়ার ধারাবাহিকতায় এবার ভারতের কাছ থেকে পাওয়া হলো মুক্তিযুদ্ধে যৌথবাহিনীর ব্যবহার করা একটি এমআই-৪ হেলিকপ্টার ও দুটি পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক। বুধবার বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি বাশারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্মারক তিনটি হস্তান্তর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত স্মারক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। পিটি-৭৬ মডেলের ট্যাঙ্ক দুটি গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল নাজিম উদ্দিন। এমআই-৪ মডেলের কপ্টারটি গ্রহণ করেন সহকারী বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আবুল বাশার। জানা যায়, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আর্মড রেজিমেন্টের ট্যাঙ্ক পিটি-৭৬। হাল্কা ধরনের উভচর ট্যাঙ্ক নদীমাতৃক বাংলাদেশে ব্যবহারের পক্ষে খুব উপযোগী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীকে ঘন ঘন নদী ও জলাশয় পাড়ি দিতে হয়েছে। আর তখন তারা ব্যবহার করেছেন পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক। গরীবপুরের আলোচিত যুদ্ধে এই ট্যাঙ্কগুলো ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এম ৩৪ শ্যাফে ট্যাঙ্কসমৃদ্ধ পাকিস্তানী বাহিনীর একটি বড় দল ওই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। একইভাবে ট্যাঙ্ক দুটি ব্যবহার করে উত্তারাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে যৌথবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের এতকাল পর এম আই-৪ হেলিকপ্টারের ভূমিকার কথা জেনেও অবাক হতে হয়। জানা যায়, একাত্তরে এটি ভারতীয় বিমানবাহিনীর পরিবহন হেলিকপ্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলে আকাশপথে যৌথবাহিনী যে অপারেশন চালায়, সেখানেও ছিল এই হেলিকপ্টার। একই হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয় সিলেটকে মুক্ত করতে। ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়ন অপারেশনের জন্য সুরমা নদীর তীরে সিলেটের উপকণ্ঠে অবতরণ করেছিল। এখানেই শেষ নয়, বহুল আলোচিত মেঘনা হেলিব্রিজ অভিযানে অংশ নেয় এম আই-৪। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর হেলিকপ্টারযোগে প্রমত্তা মেঘনা নদীর চরে অবতরণ করেছিল ৩১১ পদাতিক ব্রিগেড। মেঘনা পাড়ি দিয়ে হেলিকপ্টারটি থেকে টানা ৩৬ ঘণ্টায় দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর ওপর ১১০ বার আক্রমণ করা হয়েছিল। ইঞ্জিন কিংবা যন্ত্রপাতি এখন আর আগের অবস্থায় নেই। তবে যুদ্ধ জয়ের গৌরব আছে। সেই গৌরবের স্বাক্ষী এম আইÑ৪ হেলিকপ্টার। ভারতের কাছ থেকে স্থায়ীভাবে পাওয়া নিদর্শনগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী তাদের নিজ নিজ জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানা যায়। স্মারক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হস্তান্তর একটি চলমান উদ্যোগ। এর আগে ভারতীর বিমানবাহিনী বাংলাদেশকে একটি হান্টার জেট ফাইটার, একটি ডাকোটা পরিবহন বিমান উপহার দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী দিয়েছে ছয়টি ৩.৭ হাভিটজার (ছোট কামানবিশেষ) বন্দুক। নৌবাহিনী প্রদান করেছে আইএনএস বিক্রান্ত, যুদ্ধে অংশ নেয়া জাহাজের মডেল এবং সংরক্ষিত আলোকচিত্র। স্মারকগুলো ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী এবং একটি অভিন্ন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। ভারতে বাংলাদেশের অনেক সুখ্যাতি আছে। এ দেশের জনগণ যেভাবে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তার প্রশংসা করেন শ্রিংলা। বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার সুযোগ পেয়ে আমরা গর্বিত। স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলাদেশ-ভারতের সৈন্য ও জনগণের সাহস, বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও গৌরবের সাক্ষ্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক গ্রহণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল নাজিম উদ্দিন ও সহকারী বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আবুল বাশার ভারতীয় বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। এ সময় মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথাও স্মরণ করেন তারা। জানা যায়, এর আগে গত বছরের ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মারক উপহার দেন। উপহারের তালিকায় ছিল শিল্পকর্ম, আলোকচিত্র, অডিও-ভিডিও ক্লিপিং, মানচিত্র, যুদ্ধের নানা দলিল, পত্রিকার ক্লিপিং এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র। ছিল ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের ব্যবহার করা পিস্তল, রাইফেল, মেশিন গান, মর্টার, রকেট লঞ্চার জাতীয় জাদুঘরে প্রদান করা হয়। ইতোমধ্যে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করে নিদর্শনগুলো দর্শনার্থীদের দেখিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। আর তার পর বুধবার ট্যাঙ্ক ও হেলিকপ্টারের মতো বড় স্মারকগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনের দিক থেকে আরও সমৃদ্ধ হলো বাংলাদেশ। পাশাপাশি দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্যমান সুসম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
×