ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সস্তা শিশুশ্রমের ওপর ভিত্তি করেই টিকে আছে বিড়ি শিল্প

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২১ এপ্রিল ২০১৮

সস্তা শিশুশ্রমের ওপর ভিত্তি করেই টিকে আছে বিড়ি শিল্প

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নয় বছরের মুক্তি একজন বিড়ি শ্রমিক। রংপুরের হারাগাছায় পাঁচ সদস্যের পরিবারে বেড়ে ওঠা তার। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র সাত বছর বয়স থেকেই মা ও বোনের সঙ্গে বিড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয় সে। প্রতি শনিবার এবং সোমবার কারখানায় গিয়ে সে তার মায়ের সহযোগী হিসেবে কাজ করে সকাল আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যেই তাকে ৫ হাজার বিড়ির খালি ঠোস তৈরি করতে হয়। মুক্তির মা প্রতি সপ্তাহে ১৮ হাজার বিড়ি তৈরির টার্গেট নেন। এর মধ্যে ৯ হাজার বিড়ির খালি ঠোস তৈরি করে মুক্তি এবং তার মা ও বোন খালি ঠোস তৈরির পাশাপাশি তাতে তামাকের গুঁড়ো ভরা, ঠোসের মাথা মুড়ানোসহ বিড়ির প্যাকেট তৈরি করে বস্তাবন্দী করেন। প্রতি সপ্তাহে ১৮ হাজার বিড়ির জন্য মুক্তির মা ৩৩০ টাকা উপার্জন করেন। এর মধ্যে মুক্তা পায় ৭০ টাকা অর্থাৎ প্রতি মাসে তার রোজগার ২৮০ টাকা। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর কাজের চাপে মাধ্যমিক থেকে পড়ালেখায় অনিয়মিত হয়ে যায় মুক্তি। সেইসঙ্গে তার শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। ধীরে ধীরে সে রোগা হওয়ার পাশাপাশি জ্বর ও কাশিতে ভুগতে শুরু করে ৯ বছরের মুক্তি। শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে স্কুলে যাওয়া ও কাজে যাওয়ায় ভাটা পড়ে। বিড়ি তৈরির কাজ প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে চুপ হয়ে যায়! মুক্তির মতো অনেক শিশু বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের যেসব জেলায় প্রচুর তামাক জন্মায় (বিশেষত: রংপুর এবং লালমনিরহাট), সেখানকার দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারগুলোর শিশুদের সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে বিড়ি শিল্প। স্থানীয় অধিবাসীদের হিসাবে, প্রতিটি বিড়ি কারখানার ৬০-৬৫ ভাগ শ্রমিকই বয়সে শিশু। লালমনিরহাট জেলায় দেখা গেছে, ২১ হাজার বিড়ি শ্রমিকের মধ্যে ১৫ হাজারই শিশু, যাদের বয়স ৪ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। উল্লেখ্য যে, ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ অনুযায়ী, ১৪ বছরের আগে কোন শিশুকে কর্মে নিয়োগ দেয়া অবৈধ। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জড়িত হাজার হাজার শিশুকে দাসের মতো খাটিয়েই দিনের পর দিন নিজেদের মুনাফা বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশের বিড়ি শিল্প। মাদক বিরোধী বেসরকারী সংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার উদ্যোগে (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বিহেভিয়েরাল এ্যান্ড হেলথকেয়ার রিসার্চ’ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে সম্প্রতি এই চিত্রই উঠে এসেছে। ‘শর্ট-টার্ম গেইনস এ্যাট দ্য কস্ট অব লং-টার্ম বেনেফিটস: চাইল্ড লেবার ইন বিড়ি ফ্যাক্টরিস অব বাংলাদেশ; শীর্ষক এই গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে, কিভাবে বিড়ি মালিকদের মুনাফা জোগানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে গোটা দেশের ভবিষ্যতই সঙ্কটের মুখে পড়ছে। এছাড়া বিড়ি কারখানায় শিশু শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর এবং অমানবিক কাজের পরিবেশ নিয়ে বিশদ পর্যবেক্ষণ রয়েছে এই গবেষণায়। শৈশবের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি চরম ঔদাসীন্য দেখিয়ে যে শিল্প চলছে, তা নিরুৎসাহিতকরণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি তামাকপণ্যে বর্ধিত করারোপের প্রতি এই গবেষণায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গবেষণাপত্রে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, বিড়ি এবং অন্যান্য তামাকপণ্যে কর বাড়িয়ে ভোক্তা পর্যায়ে এগুলোর দাম বাড়িয়ে তুলতে হবে। কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে যদি বিড়ির চাহিদা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা যায়, তাহলে বিড়ি কারখানাগুলো বাধ্য হবে নিজেদের উৎপাদন এবং বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে। জানা গেছে, বিড়ি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যে শিশুরা কাজ করে, তাদের বেশিরভাগই প্রাথমিক শিক্ষাও শেষ করতে পারে না। টাকা উপার্জনের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে যে চাপ এবং কোম্পানির পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সংখ্যক বিড়ি তৈরির ভার মাথায় থাকায় বেশিরভাগ শিশু শ্রমিকই স্কুলে যাওয়া বা খেলাধুলার সময় পায় না। এর ফলে লেখা পড়া শেখা বা অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে অন্য কোন দক্ষতা অর্জনের সুযোগও তাদের হয় না। পাশাপাশি এসব শিশু শ্রমিকের প্রায়শই ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, তলপেটের প্রদাহ, ডায়রিয়া এবং পেশির ব্যথায় ভুগতে দেখা যায়। তামাকের গুঁড়োতে ভর্তি থাকা কারখানার বাতাস থেকে তাদের রক্ষার জন্য কোন ধরনের সুরক্ষামূলক গ্লভস কিংবা মাস্ক দেয়া হয় না। বিড়ি কারখানায় কাজ করতে আসা নারীরা প্রায়শই সঙ্গে করে তাদের শিশু সন্তানদের কারখানায় নিয়ে আসেন। রংপুরের এক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের প্রায় ৮০ ভাগই বিড়ি কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন বা একসময় কাজ করেছেন। তামাক রিবোধী সংগঠন প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের জনকণ্ঠকে জানান, ‘বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত অন্য যেকোন শ্রমিকের তুলনায় কম মজুরি পান বিড়ি শিল্পের শ্রমিকরা। বিড়ি এবং জর্দা শিল্পে একজন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের দৈনিক গড় মজুরি যথাক্রমে ৩৫ এবং ৪৮ টাকা মাত্র। আর একবার যে বিড়ি শ্রমিক হয় তার জীবন কেটে যায় কারখানায়। বিড়ি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যে শিশুরা কাজ করে, তাদের বেশিরভাগই প্রাথমিক শিক্ষাও শেষ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুসারে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে মোট ৩৮ কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, যেগুলো শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং স্বাস্থ্যহানিকর। আজকের শিশুরাই আগামী দিনে দেশের হাল ধরবে। তাই একজন শিশু কোনভাবেই অর্থ তৈরির হাতিয়ার কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানের একক সম্পদ হতে পারে না। সুতরাং একটি গঠনমূলক উপায়ে শিশুদের বড় করে তোলা না হলে, দীর্ঘমেয়াদে দেশের ভবিষ্যতই প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে জানান তিনি। এগারো বছর বয়সী সুখী ও মুক্তার মতোই প্রাথমিকের গ-ি পেরোলেও মাধ্যমিক থেকে আর নিয়মিত স্কুলে যেতে পারেনি। লালমনিরহাট জেলার বাণীপাড়ায় সুখী তার পরিবারের সঙ্গে বাস করে। সপ্তাহের পাঁচদিন ভোর পাঁচটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সে তার বাবার সঙ্গে বিড়ি কারখানায় কাজ করে। প্রতি ১০ হাজার বিড়ি প্রস্তুতের মধ্য দিয়ে দিনে ২৪০ টাকা উপার্জন করত সে ও তার বাবা। সুখী প্রতিদিন ১ হাজার বিড়ির খালি ঠোস তৈরি করে এবং দিন শেষে তার অর্জন মাত্র ৪০ টাকা অর্থাৎ প্রতিমাসে ৮০০ টাকা তার আয়। সুখীর মা-বাবা তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে বরাবরই উদাসীন। মেয়ের উপার্জন তাদের স্বস্তি দেয়। কেননা, সুখীর উপার্জন জমানো হচ্ছে তার বিয়ের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে যে সুখী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সে দিকে কারও নজর পড়েনি। মুক্তার মতোই ধীরে ধীরে সুখীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। জ্বর, কাশিসহ সে দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় দিন পার করছে সে। দারিদ্র্যের কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ারও ক্ষমতা নেই তার। সুখীর এলাকার অনেক শিশুই তার মতো বিড়ি কারখানায় বিপজ্জনক পরিবেশের মধ্যে কাটাচ্ছে তাদের শৈশব। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় জানিয়ে এবিএম জুবায়ের বলেন, বিড়ি শিল্পে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিড়ি কারখানাগুলোর বাইরে ‘শিশুশ্রম নিষিদ্ধ’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুললেও ভেতরে ঠিকই শিশুদাসদের খাটিয়ে যাচ্ছে কারখানা মালিকরা। আইনভঙ্গকারীদের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, এমন নজিরও নেই। জনসাধারণের মধ্যে বিড়ির চাহিদা কমানোর অন্যতম উপায় হলো, বিড়ি উৎপাদন প্রক্রিয়ার চিত্রটি সকলের সামনে তুলে ধরা। বিড়ি কারখানায় কাজ করার মাধ্যমে একজন শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যের দিক থেকেও দুর্বল হয়ে পড়ে সে। একমাত্র চিত্তাকর্ষক এবং কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থাই পারে স্কুল থেকে শিশুদের ঝরে পড়া রোধ করতে। পাশাপাশি বিড়ি শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা এবং জীবনমানের উন্নয়ন করতে হবে। কারণ বিড়ি শিল্পের মৃত্যুফাঁদে শিশুশ্রমের ব্যবহার কমাতে হলে শেষ পর্যন্ত এই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। কারণ একটি সুখী এবং সচ্ছল পরিবার কখনই তার শিশুকে এই মৃত্যুফাঁদে ঠেলে দেবে না। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বিহেভিয়েরাল এ্যান্ড হেলথকেয়ার রিসার্চ’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বর্ধিত করারোপের মাধ্যমে বিড়ির চাহিদা হ্রাস করার মাধ্যমে এই সঙ্কটের সমাধান সম্ভব বলে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিড়ি এবং অন্যান্য তামাক পণ্যের ওপর বর্ধিত করারোপের মাধ্যমে ভোক্তাস্তরে এসব পণ্যের দাম বাড়ানো যেতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক পণ্যের দাম ১০ ভাগ বাড়লে নিম্ন এবং মধ্য আয়ের ভোক্তাদের মধ্যে এর ব্যবহার ৮ থেকে ১০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়। উল্লেখ্য, তামাক ব্যবহারকারী নিয়ে কাজ করার সময় নিম্ন আয় এবং উচ্চ আয়ের ভোক্তাদের মধ্যে পার্থক্য করা বিশেষ প্রয়োজন। পণ্যের দামবৃদ্ধির প্রতি নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং এরফলে তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাসেও তারা সচেষ্ট হন। তামাক পণ্যের দাম ৫০ ভাগ বাড়লে গোটা বিশ্বে অন্তত ৬৭ মিলিয়ন পুরুষ তাদের ধূমপানের অভ্যাস ছেড়ে দেবেন। এই পুরুষদের বেশিরভাগই বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাসিন্দা। এছাড়াও দেখা গেছে, তামাক ব্যবহারে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অন্যান্য যত স্বাস্থ্যঝুঁকি, তাতে বেশি ভোগেন দরিদ্র ব্যবহারকারীরাই। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের থাকে না। এসব কিছু বিবেচনায় এনেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক পণ্যের ওপরে অন্তত ৭০ শতাংশ করারোপের ওপর জোর দেয়, যদিও বেশিরভাগ দেশই সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি। কার্যকর করারোপের মধ্য দিয়ে যদি বিড়ির চাহিদা কমিয়ে আনা যায় এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের মধ্যে যদি বিড়ির ব্যবহার হ্রাস পায় বা তাদের একটি বড় অংশ যদি ধূমপান ছেড়ে দেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত বিড়ি কারখানাগুলোর উৎপাদন এবং বিনিয়োগ কমিয়ে আনা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। উৎপাদন কম হলে শ্রমশক্তির দরকারও হবে তুলনামূলক কম। এভাবে বর্ধিত করারোপের দ্বারা উৎপাদন এবং সরবরাহ কমিয়ে নিয়ে আসার মাধ্যমে বিড়ি শিল্পে শিশুশ্রমও কমিয়ে আনা যাবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তামাক পণ্যের ওপর বর্ধিত করারোপ করা হলেও তার প্রয়োগ যথাযথভাবে হয়নি। এর ফলে উল্টো বিড়ি এবং জর্দার মতো সস্তা তামাক পণ্যগুলোর চাহিদা বেড়ে গেছে।
×