ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রহস্যময় ট্রেন যাত্রায় কিম

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৪ এপ্রিল ২০১৮

রহস্যময় ট্রেন যাত্রায় কিম

কিম জং উন। উত্তর কোরিয়ার একনায়ক। সারাবিশ্বে খ্যাত ‘মিসাইল ম্যান’ পরিচয়ে। বেপরোয়া। কথায় কথায় হুমকি দিয়ে বিশ্ব রাজনীতির আলোচিত নাম। রহস্যময় জীবনযাপন। রহস্য আর জল্পনা-কল্পনা যার নিত্যসঙ্গী। সম্প্রতি জন্ম দিলেন আরেক রহ্যসের। এবারের জল্পনা-কল্পনার শুরু নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনিতে ঘেরা এক রহস্যম ট্রেনকে ঘিরে। বিন্দুমাত্র আভাস ছিল না। ছিল না আগাম কোন তথ্য। কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই উত্তর কোরিয়ার একটি ট্রেন গত সপ্তাহের সোমবার প্রবেশ করে চীনের রাজধানী বেজিংয়ে। বিষয়টি প্রথম জানায় জাপানের একটি সংবাদমাধ্যম। ব্যাস, ডালপালা মেলা শুরু গুজবের। ঘুম হারাম বিশ্ব রাজনীতির প-িত মহলের। কে ছিলেন সেই ট্রেনের যাত্রী। তবে কি উত্তর কোরিয়ার কর্তা কিম জং উন চীনে এসেছেন? বিষয়টি সত্য হলে, ২০১১তে ক্ষমতায় আসার পরে এটাই কিম জং উনের প্রথম বিদেশ সফর। কিমের বাবা কিম জং-ইল মৃত্যুর অল্প ক’দিন আগে ২০১১তে ঠিক এ রকম একটি ট্রেনে চড়েই এসেছিলেন চীনে। দুটি ট্রেনের মিলও সন্দেহ ছড়ানোয় বড় ভূমিকা রেখেছে। সবার প্রশ্ন কার জন্য এত নিরাপত্তা? ট্রেনটাই বা কার? উত্তর কোরিয়া বা চীনা কর্তৃপক্ষ সোমবার রাত অবধি জানায়নি কিছু, একেবারে স্পিকটি নট। সবার মুখে তালা। জাপানী সংবাদমাধ্যমগুলো আরও জানায়, উত্তর কোরিয়া-চীন সীমান্তের মৈত্রী সেতু পেরিয়ে ট্রেনটি চীনের ড্যানডং হয়ে বেজিং পৌঁছায়। অন্যপ্রান্তে প্রস্তুতি চলছিল জোরেশোরে। চীনা সেনারা কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছিল প্ল্যাটফর্মের দিকে। সারি সারি কালো লিমুজিন দাঁড়িয়ে স্টেশনে। গ্রেট হল অব দ্য পিপলস-এর সামনে উত্তর কোরীয় দূতাবাসের গাড়ি। বিদেশী রাষ্ট্রনায়করা এলে যেখানে থাকেন, সেই দিয়াও ইউ তাই গেস্ট হাউস প্রস্তুত মান্যবরকে বরণ করে নিতে। কিছু সন্দেহও ছিল। গত কিছুদিন ধরে সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না চীন-উত্তর কোরিয়া দুই কমিউনিস্ট দেশের। চীনে শির একনায়ক হয়ে ওঠাও দিন বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে চীন বুধবার ঘোষণা করে যে, কিম চীন সফরে এসেছেন এবং বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে । চীনের সরকারী সংবাদমাধ্যম শিনহুয়া নিউজ জানায়, রবিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত বেসরকারী সফরে চীনে এসেছিলেন উত্তর কোরিয়ার শাসক। শি ও তার স্ত্রী পেং লিউ ইয়ান স্বাগত জানান কিম ও তার স্ত্রী রি সোল জুকে। তার দেশ শান্তি প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেয়ার পরই কোরিয়ার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নত হয়েছে বলে শির কাছে দাবি করেছেন কিম! শিনহুয়া নিউজের দাবি অনুযায়ী তিনি আরও বলেন, কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা এককাট্টা। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কিম টু সুং ও প্রয়াত জেনারেল সেক্রেটারি কিম জম টু-এর ইচ্ছাও তাই ছিল। আগামী এপ্রিল মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে কিমের। এর পরেই বৈঠকের কথা রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও। তার আগে এমন অকস্মাত এবং প্রায় গোপন চীন সফরের কূটনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে শোরগোল পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। এক দিকে পুতিনের রাশিয়ার ওপরে নানা মহল থেকে কূটনৈতিক চাপ। মার্কিন-রুশ কূটনৈতিক বহিষ্কার পাল্টা বহিষ্কারে উত্তপ্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গন। অন্য দিকে আজীবন ক্ষমতায় থাকার অধিকার পাওয়া শি জিনপিং এবং ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধের পটভূমিকায় কিমের এই সফরকে নিয়ে এসেছে অন্য আলোয়। জানা গেছে কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করতে প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে একঘরে উত্তর কোরিয়ার দিকে আবার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। চীন যে কিমের সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটা রাজকীয় অভ্যর্থনার মধ্যেই স্পষ্ট। কিমের সম্মানে বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা করেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ইতিহাস বিজড়িত বেজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলসে দুই নেতার মধ্যে দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। জানা গেছে, বৈঠকে যত না বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে কিম শুনেছেন চীনা প্রেসিডেন্টের কথা। কিমের জন্য বিষয়টি নতুন বৈকি! প্রশ্ন উঠেছে, আচমকা কেন চীন সফরে কিম? দেশে ফিরে উত্তর কোরিয়ার সরকারী সংবাদ সংস্থাকে কিম জানিয়েছেন, ‘উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের। সেই সম্পর্কের খাতিরেই প্রথম বিদেশ সফরের জন্য চীনকে বেছে নেয়া।’ অন্যদিকে কিম জং উনের বেজিং সফর ঘিরে চাঞ্চল্য শেষ হতে না হতেই বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়া জানিয়েছে, আগামী ২৭ এপ্রিল তাদের প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের সঙ্গে দেখা করবেন কিম। দু’দেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম পান মুন জমে সিউল ও পিয়ংইয়ংয়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠকের পরে এই কথা জানানো হয়েছে। ৪ এপ্রিল এ নিয়ে আবার আলোচনায় মিলিত হবেন তারা। ১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে মাত্র দু’বার ২০০০ এবং ২০০৭ সালে মুখোমুখি হয়েছেন দুই কোরিয়ার নেতারা। বৃহস্পতিবারের বৈঠকের পরে দক্ষিণ কোরিয়ার সংযোগকারী মন্ত্রী চো মিয়-গিয়ন বলেছেন, ‘দু’পক্ষই চায় আন্তরিক আলোচনা হোক। কিম-মুন আলোচনায় কোরীয় উপদ্বীপে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ, শান্তি বজায় রাখার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।’ উত্তর কোরিয়ার সরকারী প্রতিনিধি রি সন গোওনের নেতৃত্বে তিন জন ছিলেন এ দিনের বৈঠকে। তারাও কিম-মুনের মধ্যে ইতিবাচক বৈঠকের আশ্বাস দিয়ে জানিয়েছেন, দুই রাষ্ট্র নেতার মধ্যে আলোচনার জন্য পরবর্তীকালে টেলি সংযোগে হটলাইন স্থাপনের কথা ভাবা হবে। কূটনীতিকরা মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে কথা বলার আগে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কের উন্নতির বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে কিম ও শিয়ের আলোচনাতে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বেজিং, সিউল, ওয়াশিংটন এবং ভবিষ্যতে মস্কো ও টোকিওÑ প্রতি ক্ষেত্রেই আলাদা করে আলোচনা চালিয়ে উত্তর কোরিয়ার লক্ষ্য, এসব দেশের মধ্যে জোটশক্তির সম্ভাবনাকে নষ্ট করা। অন্যতম মিত্র দেশ চীনকে হাতে রেখে এখন পিয়ংইয়ং চাইছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং আমেরিকার ওপরে চাপ তৈরি করতে। কূটনীতিকদের ধারণা, পরমাণু অস্ত্র প্রকল্পের জেরে মাথার ওপরে চেপে বসা নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ কিম নিশ্চয়ই তুলেছেন বেজিংয়ের সঙ্গে আলোচনায়। তাদের ধারণা শুধু প্রসঙ্গ তোলা নয়, ভবিষ্যতে ওয়াশিংটন এবং সিউলের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলে যদি আবার নিষেধাজ্ঞা চাপানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রও চীনকে পাশে চেয়েছে উত্তর কোরিয়া। কারণ তাদের মতে, পিয়ংইয়ং নিরস্ত্রীকরণের কথা মুখে যতই বলুক, কার্যক্ষেত্রে তার কতটা সত্য হবে সে প্রশ্ন রয়েই যায়। অন্য দিকে সমস্যা আছে চীনেরও। আগামী মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাাম্পের সঙ্গে কিমের বৈঠকের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। চীনের আশঙ্কার জায়গাটা হলো, সেই বৈঠক সফল হলে কিম হয়ত চীনের কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাবেন। তাই রাজকীয় আতিথেয়তা দিয়ে চীনও কিমকে কাছে টানার বার্তাই দিয়ে রাখল।
×