ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উগ্রবাদ, অভ্যন্তরীণ ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ

রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখতে ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখতে ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ বাধাগ্রস্ত করতে ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখতে শুরু হয়েছে স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতা। সরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপদে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক আলোচনাসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দুটি সংগঠন ও কয়েকটি এনজিও প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীদের নানা অপতৎপরতায় স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। সীমান্ত এলাকার অধিবাসীরা জানান, আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমারের সুর যতই নরম হোক না কেন, তারা আন্তরিকভাবে রোহিঙ্গা ফেরত নিতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া স্বার্থান্বেষী মহলের বিভিন্ন উস্কানিতে রোহিঙ্গারাও সহজে নিজ দেশে ফিরে যেতে রাজি নয়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের মূল হোতা মিয়ানমার অভ্যন্তরে থাকা সশস্ত্র সংগঠন আরসার ক্যাডাররা চাইছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকুক। পুরনো রোহিঙ্গা তথা আরএসও ক্যাডাররাও চেষ্টা চালাচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবতন না হোক। রোহিঙ্গাদের ওই দুটি সংগঠন এবং একাধিক এনজিও মিলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের সঙ্কট বিশ্বের এক মানবিক সমস্যা। রাখাইন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ এ সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা। অতীতেও দেখা গেছে, মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন করে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে বার বার চেষ্টা চালিয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর অন্তত ছয় বার রোহিঙ্গারা এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তবে অতীতের চেয়ে এবারে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। ইতোপূর্বে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা থেকে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কৌশলে তারা দীর্ঘদিন এদেশে বসবাস করলেও কোন সময় বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেনি। নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে মরিয়া রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী। প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকা- চালিয়েছে। এবারও ওই পুরনো রোহিঙ্গা ক্যাডাররা প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত বিরোধী কর্ম তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। যার কারণে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, উগ্রবাদ, সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে অভিজ্ঞজনরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে বিজিবি জওয়ানরা বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে নিয়মিত টহল জোরদার করেছে বিজিবি। সূত্র জানায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আল-ইয়াকিন (আরসা), আরএসও এবং একাধিক এনজিও প্রতিনিধি নিজ নিজ অবস্থান থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রিত নতুন ও পুরনো মিলে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিহ্নিত তিনটি গ্রুপ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে পরিকল্পনা নিয়েই গোপনে নানা ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছে। এতে একটি গ্রুপের সঙ্গে (আরসা) মিয়ানমারের কতিপয় সেনা কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। অপর দুটি গ্রুপ আরএসও এবং এনজিও প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বানচাল করতে আশ্রিত ক্যাম্পে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের সক্রিয় করে গড়ে তুলছে। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্য থেকে কতিপয় পুরনো রোহিঙ্গা নেতা ছদ্মবেশে টেকনাফ-উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ওই পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা নিজেদের ঠিকাদার বা প্রতিনিধি দাবি করলেও তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী গ্রুপের সদস্য বলে সূত্র আভাস দিয়েছে। ক্যাম্পে অনায়াসে প্রবেশ এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিরোধী ইন্ধন দিতে আরএসও ক্যাডাররা শেড কক্ষ মেরামতের কাজ বেছে নিয়েছে। এদের মধ্যে পুরনো রোহিঙ্গা নেতা মৌলবি আয়াছ, মৌলবি ওসমান, মৌলবি শফিক ও মৌলবি নুরুল হোসেন অন্যতম বলে জানা গেছে। সীমান্তের একাধিক সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপ আরসার সন্ত্রাসীদের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে। রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে ঘটনার সূত্রপাত ঘটানোর পর গত ছয় মাসেও সশস্ত্র সংগঠন আরসার প্রধান বা উল্লেখযোগ্য একজন সন্ত্রাসীকে ধরতে পারেনি মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী। রাখাইনে রোহিঙ্গা শূন্য করার পরিকল্পনায় আরসার সন্ত্রাসীরা দেশটির উচ্চপদস্থ একাধিক সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে অঢেল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অসমর্থিত খবরে জানা গেছে। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাতে মংডুর তিনটি পুলিশ চৌকিতে হামলা ঘটনার পর রোহিঙ্গারা দলে দলে অনুপ্রবেশ করতে চাইলে বাংলাদেশ বাধা দেয়। সীমান্তরক্ষী বিজিবি ও কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই সময় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। সূত্র মতে, ওই সময় বাংলাদেশ সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করায় আশা পূরণ হয়নি মিয়ানমার ও আল-ইয়াকিনের (আরসা)। ২০১৬ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা শূন্য করা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করা হয়। ওইসময় দেশটির স্টেট কাউন্সেলর আউং সান সুচি জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আনানকে প্রধান করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কোফি আনানের কমিটি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জবানবন্দী গ্রহণ ও মিয়ানমার সফর করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের মতামত ব্যক্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করছেন খবর পেয়ে ফের সহিংসতার পরিকল্পনা গ্রহণ করে মিয়ানমার সেনা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করার সিদ্ধান্ত মতে গত বছরের ২৫ আগস্ট ভোরে আরসার ক্যাডাররা দেশটির নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায়। পরদিন ২৬ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরু হলে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গার স্রোত। মানবিক কারণে বাংলাদেশ আশ্রয় দেয় অন্তত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে। অভিজ্ঞজনরা বলেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে মিয়ানমার সেনা বাহিনী যেমন উল্লাসিত, তেমনি রাখাইনে ঘটনা সৃষ্টিকারী রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী জঙ্গী সংগঠন আরসার সন্ত্রাসীরাও একেবারে চুপচাপ। সম্পূর্ণ পর্দার আড়ালে চলে গেছে আরসার ক্যাডাররা। এ জন্য রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মিয়ানমার সেনা বাহিনী ও আরসার মধ্যে গোপন আঁতাত থাকতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন তারা। আরএসওর যেসব ক্যাডার আরসায় যোগ দিয়েছে, তাদের সঙ্গে পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের যোগাযোগের বিষয়টিকেও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তারা আরও বলেন, ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাকরিকত্ব কেড়ে নেয়ার আইন করার পর থেকে দেশটিতে রোহিঙ্গা শূন্য করার সুযোগ খুঁজছিল। আন্তর্জাতিক ভাবে চাপের মুখে না পড়ার লক্ষ্যে আল-ইয়াকিনকে (আরসা) হাতে নেয় মিয়ানমার। তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই রাখাইন রাজ্য থেকে ঠেলে দেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে সহজে ফিরিয়ে নিতে চাইবে না মিয়ানমার। আশ্রিত রোহিঙ্গারাও এনজিও এবং আরএসওর উস্কানিতে সহজে স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে না। বিশ্বের চাপে পড়ে কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নিলেও মাঝপথে বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করতে পারে মিয়ানমার। এ জন্য বাংলাদেশের ওয়ার্কিং গ্রুপকে কঠোর হওয়ার এবং প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে রোহিঙ্গাদের ছেঙ্গারচর-ভাসানচরে স্থানান্তর করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এদিকে রোহিঙ্গার ঢল আসার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সেবার নামে কর্মতৎপরতা শুরু করে শতাধিক এনজিও। ইতিমধ্যে চিহ্নিত কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশী ফান্ড এনে ইচ্ছেমতো খরচ করতে রোহিঙ্গাদের প্রতি মমতা বাড়িয়ে দেয়। ওই এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘মা’র চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ অবস্থা সৃষ্টি করে কিছু কিছু এনজিও মহিলা কর্মী রোহিঙ্গা নারীদের মাথায় তেল লাগানো থেকে শুরু করে হাতের নখ পর্যন্ত কেটে দিচ্ছে। অতি দরদ দেখাতে রোহিঙ্গা শিশুদের কোলে নিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ওই এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার আগমনে অত্যন্ত খুশি পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা। রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ এনে সিংহভাগ আত্মসাত করতে বিভিন্ন কৌশল হাতে নিয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিরোধী কথাবার্তা নানাভাবে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে তারা।
×