ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এস এম মুকুল

বিশ্ব দরবারে ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

বিশ্ব দরবারে ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ) তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির বয়নশিল্প। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের আরেক গৌরবের নাম ছড়িয়ে পড়ল। অবশ্য এর আগেই শীতলপাটির শীতল পরশ বাংলাদেশের পাশাপাশি ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানিসহ অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ে প্রবাসী বাঙালীদের মাধ্যমে। কথিত আছে ব্রিটিশ আমলে ভিক্টোরিয়ার রাজপ্রাসাদে স্থান পেয়েছিল সিলেটের শীতলপাটি। মুর্শিদ কুলি খাঁ নীল শীতলপাটি উপহার দিয়েছিলেন স¤্রাট আওরঙ্গজেবকে। জনশ্রুতি আছে- এককালে ঝালকাঠি পাটিশিল্পী সম্প্রদায়ের মেয়েদের খুবই কদর ছিল। একটি মেয়েকে ছেলের বৌ করে ঘরে আনতে সস্তার বাজারেও কয়েকশ’ টাকা পণ দিতে হতো। শীতলপাটির সূত্রপাত সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে- প্রায় ৬০ বছর আগে বিশ্ব জনস্বাস্থ্য সংস্থার স্থানীয় পরিচালক আমেরিকাবাসী আরবুতনট ঝালকাঠি আসেন। তখন তাকে একখানা শীতলপাটি দেয়া হয়। এর বুননশৈলী দেখে তিনি খুশি হয়ে (তখনকার দিনে) ২০০ টাকা পুরস্কার দিয়ে এ শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন। মুর্তা নামক এক প্রকার সরু গাছের ছাল দিয়ে এই পাটি তৈরি করা হয়। কোথাও পাটি গাছ বা পাইত্রা গাছ বলা হয়। এই গাছ ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে, জলাশয়ে, রাস্তার ধারে আপনা থেকেই জন্মে থাকে। একটু যতœ নিলেই বছরের পর বছর পইত্রা পাওয়া যায়। গাছ বছরের পর বছর বেঁচে থাকে এবং ফলনও দেয়। অনেক পাটিশিল্পীরই নিজের পাটিবন নেই। আবার পাটিবন আছে এমন অনেকেই নিজেরা পাটি বোনার কাজ করেন না। গাছ কেটে ধারালো দা বা বটি দিয়ে গাছটিকে লম্বাভাবে ৪-৫ টুকরো করে গাছের ছাল বা বেত বের করা হয়। অতঃপর এক ঘণ্টা বেতগুলো টিনের পাত্রে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে সিদ্ধ করার পর তুলে এনে রোদে শুকিয়ে পুনরায় ঠা-া ও পরিষ্কার পানিতে ১০-১৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে তোলা হয়। এরপরই মুর্তা বেত পাটি তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হয়। বেতে রং দিয়ে পাটিকে নানা চিত্রে সাজিয়ে আরও আকর্ষণীয় করা হয়। একটি সাধারণ পাটি বুনতে সময় লাগে ১০-১৫ দিন। পাটি বিক্রি করতে হয় ৫০০ টাকা থেকে ৫০০০ হাজার টাকায়। উন্নত মানের পাটি বুনতে সময় লাগে দেড় মাস। যা বিক্রি হয় ৫ থেকে ২০ হাজার টাকায়। বুনিয়াদি এলাকা হিসেবে সিলেট জেলায় ব্যাপকভাবে তৈরি হয় শীতলপাটি। জাতীয় জাদুঘরের সমীক্ষার তথ্যানুসারে, সিলেট অঞ্চলের ১০০টি গ্রামের প্রায় চার হাজার পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শীতল পাটির জন্ম মূলত সিলেট অঞ্চলে হলেও দেশের বিভিন্ন জেলায় এ পাটি তৈরি হয়। সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, বরিশাল, ঝালকাঠি, কুমিল্লা, ঢাকা, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনায় পাটি তৈরির মুর্তা গাছ প্রচুর পাওয়া গেলেও শীতলপাটির বুননশিল্পীদের বেশিরভাগই বৃহত্তর সিলেটের বালাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এবং সিলেট জেলার নিচু এলাকায় বসবাস করেন। সিলেট ছাড়াও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প শীতল পাটিকে নিয়ে জীবনের স্বপ্ন বোনেন নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার জৈনপুর গ্রামের শতাধিক পরিবারের নারী-পুরুষ। বর্ষাকালে ভাটি এলাকায় বিয়ে বেশি হওয়ায় শীতলপাটির বিক্রিও বাড়ে এ সময়ে। ঝালকাঠির শীতলপাটি শিল্প একটি গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। জানা গেছে, অষ্টাদশ শতকের ষাটের দশকে জেলার রাজাপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে শীতলপাটি বুননের কাজ শুরু হয়। ক্রমেই তা রাজাপুরের সাংগর, হাইলাকাঠি, নলছিটির সরই, বাহাদুরপুর, ঝালকাঠি সদর উপজেলার সাচিলাপুর, রামনগর, হরিশংকর, কাঁঠালিয়ার নীলগঞ্জ, হেলেঞ্চা, কাজলকাঠিসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজলকাটি গ্রামের প্রায় ২০০ একরজুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রায় ১ হাজারটি পাইত্রা বাগান। চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার শীতলপাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিরসরাইয়ের এই শীতলপাটির চাহিদা ও কদর ব্যাপক। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের পাইট্টাল বাড়ি এ অঞ্চলে সবচেয়ে পাটি উৎপাদনকারী এলাকা। পাইটাল বাড়ির ঐতিহ্য কয়েকশ’ বছরের। বংশ পরম্পরায় ৪০০ বছর ধরে তারা পাটি উৎপাদন করে আসছে। এখানে বর্তমানে রয়েছে ৬০ থেকে ৭০টি পরিবার। পাটি তৈরির সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা চার শতাধিক। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মায়ানি ইউনিয়নের পূর্ব মায়ানি গ্রামের নারীরা শীতলপাটি বুনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। পূর্ব মায়ানি ছাড়াও মিঠানালা, সাহেরখালী, জোরারগঞ্জ, আবুরহাট, করেরহাট, দুর্গাপুরসহ উপজেলায় ৪০টি শীতলপাটির কারুপল্লী রয়েছে। গ্রামীণ গৃহবধূদের হাতের নকশায় এ গ্রামে তৈরি করা হয় শীতলপাটি, বড় চট ও ছোট চট। পাটি তৈরি শিল্পের সঙ্গে জড়িত গ্রামের ৪০টিরও বেশি পরিবার রয়েছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে পাটি, চট তৈরি ও বিক্রি করে আসছেন। কাঁচামাল ও পুঁজির অভাবে শীতলপাটি শিল্প বর্তমানে বিপুপ্তির পথে। পাটিয়াল বা পাটিশিল্পীদের নিরাপত্তা বিধান, ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় শীতলপাটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেয়া হলে পাটিশিল্পেরও বিকাশ সম্ভব হবে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, এশিয়া মহাদেশের গ্রীষ্মম-লীর দেশগুলোতে শীতলপাটির বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব হলেই এ শিল্পটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং রফতানিযোগ্য পণ্য হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
×