ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শীতলপাটি, গরম চা

শীতলপাটির বিশ্বস্বীকৃতি নতুন করে টিকে থাকার প্রেরণা

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

শীতলপাটির বিশ্বস্বীকৃতি নতুন করে টিকে থাকার প্রেরণা

সালাম মশরুর শীতলপাটি, গরম চা’ এটি সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রবাদতুল্য একটি মধুর উচ্চারণ। আমজনতার অতি পরিচিত বক্তব্য। শীতলপাটিতে বসে জম্পেশ আড্ডা,আর চুটিয়ে গল্পগুজব করে চা পানের মজাই আলাদা। আবহমানকাল ধরে বাংলার সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে শীতলপাটির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। শুধু চা পান নয়, গ্রামাঞ্চলে বিভিন্নস্থান থেকে বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনকে বসতে দেয়া, খাওয়াদাওয়া এবং ঘুমানোসহ নানান আচার-অনুষ্ঠানেও একদা শীতলপাটির ব্যবহার ছিল অন্যতম প্রধান বিষয়। ঐতিহ্যবাহী এই শীতলপাটি ক্রমে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার মতো দুরবস্থার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক শীতলপাটির বিশ্ব স্বীকৃতি লাভ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের হৃদয়ে নতুন করে টিকে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এখন মানুষের মুখে মুখে আলোচনা হচ্ছে শীতলপাটির অতীত ও ইতিহাস নিয়ে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি বিলুপ্তপ্রায় শীতলপাটির জীবনে আশার আলো জ্বালিয়েছে। পুঁজি সঙ্কট, উপকরণের অভাব, নায্যমূল্য না পাওয়াসহ নানান সমস্যার কারণে দেশের বিভিন্নস্থানের মতো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেও ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি বিলুপ্ত হতে চলেছিল। একবীজপত্রী উদ্ভিদের ছাল ‘মূর্তাবেত’। মূর্তাবেত দিয়ে তৈরি শীতলপাটির কদর ছিল সব জায়গায়। এক সময় সিলেট অঞ্চলের বিয়ে অনুষ্ঠানে অন্যসব উপকরণ-সরঞ্জামের সঙ্গে একটি শীতলপাটি দিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ছিল। জন্মদিন, বিদায় সংবর্ধনা, অতিথিবরণসহ নানান অনুষ্ঠানে শীতলপাটি সাজিয়ে ব্যবহার করা হতো। এখন এসবের ব্যবহার নেই বললেই চলে। শীতলপাটির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ সবার কাছে পছন্দের। মূর্তাবেতের নক্সা শীতলপাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। নক্সার মধ্যে মসজিদ-মন্দির, নৌকা, হাঁস, মোরগ, হাতি, পাখি ও বিড়ালসহ বিভিন্ন পশু-পাখির ছবি তৈরি করা হতো। এক সময় সিলেট বিভাগের বিভিন্নস্থানে শীতলপাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত হাজারো পরিবার। এছাড়া, বাণিজ্যিকভাবে শীতলপাটি তৈরি ছাড়াও গ্রামের লোকজন নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেও ঘরে বসে নিজেরাই মূর্তাবেত দিয়ে শীতলপাটি তৈরি নিতেন। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই তখন মূর্তাবেত পাওয়া যেত। বাড়ির পাশের পুকুর বা ডোবা-নালার আশপাশে মূর্তাবেতের জন্মাত, যা ছিল সহজলভ্য। একটি সাধারণ পাটি বুনতে সময় লাগে ১৮/২০ দিন। পাটি বিক্রি করতে হয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা এবং উন্নতমানের একটি পাটি বুনতে সময় লাগে প্রায় দেড়মাস। এটি বিক্রি করতে হয় ১৫-২০ হাজার টাকায়। শীতল পাটির সঙ্গে জড়িতরা জানান, মূর্তা কিনে পাটি বানাতে যে পরিমাণ খরচ ও সময় ব্যয় হয় তাতে তাদের আয়-ব্যয়ে পোষানো কঠিন হয়ে যায়। পুঁজি সঙ্কট এবং ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জটিলতার কারণে অনেকেই এই ব্যবসা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। শীতলপাটির প্রধান উপাদান মূর্তা নামের একবীজপত্রী উদ্ভিদের ছাল; যা ‘মূর্তাবেত’ নামে পরিচিত। সিলেটের হাওড় এলাকায় এক সময় মূর্তাবেত জন্মাত প্রচুর। বাড়ির পাশের স্যাঁতসেঁতে জায়গা, জঙ্গল, অনাবাদী জমিতে হামেশাই পাওয়া যেত মূর্তাগাছ। অপিরকল্পিত নগরায়ন, আবাসন, বন-জঙ্গল সাফ করে ফেলায় বর্তমানে এই গাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। আশির দশকে সরকার মূর্তাগাছ উৎপাদনের জন্য সিলেটের কৃষকদের ঋণ দেয়ার কথা বললেও পরবর্তীকালে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৫ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজারে বেসরকারী উদ্যোগে বাণিজ্যিক লাভের আশায় মূর্তার চাষ শুরু হলেও দু-তিন বছর পর সেই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের এক শ’র মতো মূর্তামহাল রয়েছে। এগুলো দুই বছর মেয়াদে লিজ দেয়া হয়। নতুন নতুন জমিতে মূর্তা চাষও করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাতারগুলের বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করে মূর্তাচাষ করা হচ্ছে। এছাড়া বন বিভাগের জলাভূমিশ্রেণীর ১৫ শ’ হেক্টর জমিতে মূর্তাচাষ করার জন্য ১৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঢাকা অফিসে পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে মূর্তার সঙ্কট আর থাকবে না। সিলেটের তৈরি ‘শীতলপাটি’র সুনাম বেশ পুরনো। সিলেটকে বিশ্ব পরিম-লে আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে সিলেটের এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প। অর্ধশত বছর পূর্বেও সিলেটের শীতলপাটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম কুড়িয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বর সিলেটের শীতলপাটি আরেকদফা বিশ্ব মাত করল। ইউনেস্কোর বিশ্ব নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনট্যানজিব্ল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) তালিকায় স্থান করে নিলো ‘শীতলপাটি’। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে বিশ্বের নির্বস্তুক ঐতিহ্য সংরক্ষণার্থে গঠিত আন্তর্জাতিক পর্ষদের সম্মেলনের শেষ পর্বে ‘শীতলপাটি’র নাম উঠে আসে। এই অর্জনে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে মৃতপ্রায় এই কারুশিল্পে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত হয়েছেন মৌলভীবাজারের ধূলিজুড়া গ্রামের হরেন্দ্র দাশ। হরেন্দ্র দাশ শীতলপাটি বুনতে বিখ্যাত হওয়ায় ২০১৩ সালে সরকারীভাবে প্রশিক্ষণে যান জাপান। তিনি বলেন, আমার পূর্বপুরুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাই আমিও জড়িয়ে রয়েছি। পরিশ্রম অনুযায়ী বাজারে উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় এ কাজে আগ্রহ কমে গেছে। পূর্বপুরুষ করে গেছেন তাই আমি বাদ দিতে পারিনি। স্থানীয় বাজারে বর্তমানে তেমন চাহিদা নেই। তবে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ফরমায়েশ আসে। এ অনুযায়ী পাটি বুনে তাদের কাছে পাঠাই। এ ব্যাপারে শীতলপাটি শিল্প পরিষদের সভাপতি বেনু ভূষণ দাশ বলেন, মূলধন ও প্রশিক্ষণের অভাবে আমরা এই শিল্পকে বিকশিত করতে পারছি না। সরকারী উদ্যোগে ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়া হলে এই শিল্প দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মোঃ রাহাত আনোয়ার বলেন, বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে শীতলপাটির স্বীকৃতিলাভ সিলেটবাসীর জন্য গৌরবের। ধ্বংসের হাত থেকে যাতে শীতলপাটি রক্ষা করা যায় এজন্য সরকারী উদ্যোগে বিভিন্নস্থানে মূর্তাবেত বাগান সৃজন করা হচ্ছে। আগামীতে বন বিভাগের মাধ্যমে এই বাগান সৃজনের পরিমাণ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি শীতলপাটির এই অর্জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করবে সিলেট জেলা প্রশাসন। দেশে সবচেয়ে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হয়ে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায়। মৌলভীবাজারের রাজনগর, কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়িতেও তৈরি করা হয় বিশেষ এ পাটি বা মাদুর। এসব এলাকার পাটির কারিগর বা পাটিকররা বংশপরম্পরায় শীতলপাটির কাজ করে আসছেন। বর্তমানে অন্তত ৫ হাজার শ্রমিক এই পেশায় নিয়োজিত। শীতলপাটি বিক্রেতারা জানান, একসময় গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণ শীতলপাটি আসত, দামও ছিল কম। কিন্তু এখন মূর্তাবেতের সঙ্কটের কারণে শীতলপাটি তৈরির পরিমাণও কমে গেছে। এছাড়া, বাজারে প্লাস্টিকের মাদুর সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি দাম দিয়ে শীতলপাটি কিনতে চান না।
×