ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় রাজা ভূমিবল

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

বিদায় রাজা ভূমিবল

থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল আদুলাদিজ গত বছর যখন মারা যান, তখন তিনি ছিলেন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সময়ে সিংহাসনে থাকা শাসক। ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে তার সাত দশকের রাজত্বে অনেক সহিংস বিক্ষোভ ও সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটলেও তাকে দেশটির স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশ হিসেবে রাজার ক্ষমতা খুব হলেও থাই জনগণের কাছে তিনি ছিলেন অশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। পাঁচদিনের বিদায়ী আনুষ্ঠানিতা শেষে বৃহস্পতিবার তার মৃতদেহ দাহ করা হয়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রস্তুতি চলে এক বছর ধরে। এএফপি ও বিবিসি। পাঁচদিনের ব্যয়বহুল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শেষে তার ছেলে রাজা মাহা ভাজিরালংকর্ন বৃহস্পতিবার রাজকীয় চিতায় অগ্নিসংযোগ করেন। গ্র্যান্ড প্যালেসে শেষকৃত্যের পর শুক্রবার ভূমিবলের দেহভস্ম সংগ্রহ করে তা প্রাসাদে নিয়ে আসা হবে। এর পর আরও দু’দিন ধরে চলবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। প্রায় প্রতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। দিনটিকে জাতীয় ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ব্যবসায়ীরা এদিন দোকান বন্ধ রাখেন। বাবার মৃত্যুর পর নতুন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেন ভাজিরালংকর্ন, যদিও থাই জনগণের কাছে সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে তিনি এখনও তার বাবার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেননি। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজপ্রাসাদের বাইরে এরই মধ্যে সমবেত হয়েছে প্রচুর মানুষ। দেশটির উত্তরাঞ্চল থেকে আসা ৭২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা জানিয়েছেন, রাজাকে শেষ বিদায় জানাতে গত দু’দিন আগে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। যাতে অনুষ্ঠানটি দেখতে ভাল জায়গা খুঁজে পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৬ সালের ৯ জুন রাজা হন অদুলাদিজ। তিনি নানা গোষ্ঠী সংঘর্ষে জীর্ণ দেশটিকে একক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলেন। প্রয়াত রাজা ভূমিবলের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৯ জুন, ১৯৪৬ ॥ ব্যাঙ্ককের রাজপ্রাসাদে রহস্যময় ঘটনাগুলোতে ভাইয়ের মৃত্যুর পর মাত্র আঠারো বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন রাজা ভূমিবল। ৫ মে, ১৯৫০ ॥ সুইজারল্যান্ডে পড়াশুনা শেষে তিনি থাইল্যান্ডে ফিরে আসেন। চাচা তো বোন রানী সিরিকিতকে বিয়ে করার সপ্তাহখানেক পর রাজা হিসেবে তার অভিষেক ঘটে। অক্টোবর, ১৯৭৩ ॥ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে সামরিক ধরপাকড়ের পর ব্যাপক সংখ্যক লোক নিহত। তখন প্রথমবারের মতো তিনি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করেন। দেশটির সে সময়ের একনায়ককে তিনি নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেন। এরপর নতুন একজনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। অক্টোবর, ১৯৭৬ ॥ ডানপন্থী রাজতন্ত্রের সমর্থক মিলিশিয়ারা কয়েক ডজন বামপন্থী শিক্ষার্থীকে হত্যা করেন। এসব শিক্ষার্থীরা নির্বাসিত একনায়কের প্রত্যাবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। এই হত্যাকা-ের পর ফের অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের কমিউনিস্টবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী করতে ভূমিবল পরবর্তীতে অভ্যুত্থান মেনে নেন। মে, ১৯৯২ ॥ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্ককের রাস্তায় বিক্ষোভ নামলে বহু গণতন্ত্রপন্থী কর্মী নিহত হন। জান্তা নেতা জেনারেল সুচিন্দা কাপ্রাউন প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ করলে এ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। রাজা তখন মীমাংসার জন্য জেনারেল ও গণতন্ত্রপন্থী নেতাদের প্রাসাদে ডেকে পাঠান। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ওই বিরোধ মীমাংসায় তিনি দুই পক্ষকে ভর্ৎসনা করেন। সুচিন্দা ক্ষমতা ছেড়ে দেন। ১১ অক্টোবর, ১৯৯৭ ॥ রাজা থাইল্যান্ডের ষোড়শ সনদকে আইন হিসেবে সই করেন। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কারে এ পর্যন্ত এ-আইনকে সবচেয়ে অগ্রসর ও বড় ধরনের উন্নতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এপ্রিল, ২০০৬ ॥ থাইল্যান্ডে নিষ্পত্তিহীন এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সরকার অকার্যকর হয়ে পড়ে। অচলাবস্থার মধ্যে কোন পদক্ষেপ নিতে অপারগ হওয়ায় রাজা সর্বোচ্চ আদালতকে ভর্ৎসনা করেন। পরবর্তীতে নির্বাচন অবৈধ ঘোষিত হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৬ ॥ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে থাকসিন ক্ষমতাচ্যুত হন। তখন তিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ছিলেন। এতে দেশটিতে দশকব্যাপী রাজনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের সমর্থিত থাকসিন ও বিপরীতে ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও সেনা সমর্থিত ব্যাঙ্ককের অভিজাতদের মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধ শুরু হয়। আগস্ট, ২০০৯ ॥ জাতির উদ্দেশে রাজা এক বিরল ভাষণ দেন। টেলিভিশন ও রেডিওতে যা সম্প্রচার করা হয়। তিনি হুঁশিয়ারি করে বলেন, রাজনৈতিক বিরোধীরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে। সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ॥ ফুসফুসে প্রদাহ নিয়ে হাসপাতেল ভর্তি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো রাজা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হন। শরীরের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে তার পরবর্তী কয়েক বছর হাসপাতালে ভর্তি ও বাসায় ফিরে আসার মধ্য দিয়ে পার হয়। এপ্রিল-মে ২০১০ ॥ থাকসিন সিনাওয়াত্রা সমর্থিত ‘লাল শার্ট’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ধরপাকড়ের পুরো সময়টা রাজা নীরব ছিলেন। এতে ৯০ জনেরও বেশি নিহত ও কয়েক শ’ লোক আহত হন। ২২ মে, ২০১৪ ॥ থাকসিনের ছোট বোনা ইংলাক সিনাওয়াত্রার সরকারকে সরিয়ে থাই সেনাবাহিনী ফের ক্ষমতা দখল করে। প্রাসাদ ফের অভ্যুত্থানে অনুমতি দেয়। ৫ মে, ২০১৫ ॥ সিংহাসনে আরোহনের ৬৫ বছর উপলক্ষে রাজার জনসমক্ষে বিরল আবির্ভাব। এরপর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি সর্বশেষ জনসমক্ষে আসেন। ৯ অক্টোবর, ২০১৬ ॥ রক্তে মারাত্মক সংক্রমণের চিকিৎসা নেয়ার মাস খানেক পরে তার চিকিৎসক সতর্ক করে বলেন, রাজা স্বাস্থ্য খুবই নাজুক। ১৩ অক্টোবর, ২০১৬ ॥ বিকেল ৩টা ৫২ মিনিটে রাজা পরলোকগমন করেন। পুরো থাই জাতি শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। রাজার উত্তরাধিকারী মাহা ভাজিরালংকর্ন দশম রামা হিসেবে সিংহাসনে বসেন।
×