ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মামলা জট ৩

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারে ধীরগতি

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৮ অক্টোবর ২০১৭

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারে ধীরগতি

বিকাশ দত্ত ॥ সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা করার দায়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জের আগানগর এলাকার এক নারীকে জেলে পাঠান ঢাকার একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। ঢাকার ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক তালাকপ্রাপ্ত স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা করায় তাকে কারাগারে পাঠান। এ নারীর বিরুদ্ধে পরে বিচারক অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য নিয়ে শাস্তি দিতে পারেন বলে হয়রানির শিকার স্বামীর আইনজীবী জানান, মিথ্যা মামলা করার দায়ে এ নারীর অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং একইসঙ্গে অর্থদ-ও দেয়া যাবে বলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবেই মামলা বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। অন্যদিকে ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। এদিকে সুপ্রীমকোর্ট ও নিম্ন আদালতে দেওয়ানি-ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেও ধীরগতিতে নিষ্পত্তি হচ্ছে মামলা। যার ফলে পহাড় সম মামলার স্তূপ হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। একদিকে যেমন বিচারকরা হিমশিম খাচ্ছেন, অন্যদিকে বিচারপ্রার্থীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। দেশের ৪৬টি জেলায় ৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১ লাখ ৬০ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে একটি ট্রাইব্যুনালে সর্বোচ্চ ১০ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া ১৮টি জেলায় কোন ট্রাইব্যুনাল নেই। সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন আরও ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ করেন। যা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, যেসব জেলায় ট্রাইব্যুনাল নেই সেখানে শীঘ্রই ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হবে। সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ই ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্যোগ নেয়নি। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আছে। আশা করছি শীঘ্রই এটি ঠিক হয়ে যাবে। রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও ভোলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই। এসব জায়গায় শীঘ্রই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এসব জায়গায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমে আসবে। সেই সঙ্গে মামলাও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। ২০১৫ সালে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন আরও ৪১টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ করেন। এরপর আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে। দেশের ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মানুষ বাড়ছে, সেই সঙ্গে অপরাধও দিন দিন বেড়েই চলছে। আদালত কম থাকায় মামলা তুলনামূলকভাবে নিষ্পত্তির হার কম। প্রতি জেলায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সৎ ও দক্ষ বিচারক নিয়োগ করলে বিচারপ্রার্থীরা অল্প সময়ে ন্যায় বিচার পাবেন। পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তির হারও বেড়ে যাবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে সারা দেশের আদালতগুলোয় প্রায় ৩২ লাখ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে দেশের ৫৪টি ট্রাইব্যুনালে ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। বর্তমানে যে ১৮ জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই সেসব জেলায় ওই আইনের অধীনে দায়ের করা প্রায় ১৫ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা জজদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ঐসব মামলার বিচার করতে হয়। জেলা জজ নিজের বিচারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ওই জেলার বিচার প্রশাসনও দেখভাল করে থাকেন। তার পক্ষে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন খুবই কষ্টকর। ঐসব জেলার মধ্যে মামলার আধিক্য বিবেচনায় ১২টি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়। জেলাগুলো হলো রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, পিরোজপুর ও ভোলা। জানা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ কঠোর হস্তে দমনের লক্ষ্যে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি প্রণয়ন করে সরকার। বিশেষ এ আইনের অধীনে দায়ের করা মামলাগুলোর বিচারের জন্য প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে আইনের ২৬(১) ধারায়। প্রয়োজনে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। আইনের বিধান অনুসারে ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব ট্রাইব্যুনালে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন। এ কারণে আইনের বিধান অনুযায়ী এসব মামলার বিচার ১৮০ দিনের (ছয় মাস) মধ্যে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। মামলাজটের কারণে একটি মামলার বিচার শেষ করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলার বিচার নির্ধারিত ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন না হলে কেন হয়নি, এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে একটি মনিটরিং সেল গঠনের জন্য সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১২ মে সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়, ২০০০ সালের আইনের ৩১ক-এর (১) অনুসারে, কোন মামলা ধারা ২০-এর উপধারা (৩)এ উল্লিখিত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি না হওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালকে তার কারণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের কাছে দাখিল করতে হবে, যার একটি অনুলিপি সরকারের কাছে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারী আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকেও তার কারণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে দাখিল করতে হবে, যার একটি অনুলিপি সুপ্রীমকোর্টে পাঠাতে হবে। ২০০০ সালের ওই আইনের ৩১ ক (৩) তে বলা আছে, উপধারা (১) বা (২)-এর অধীন পেশ করা প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর যথাযথ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হওয়ায় এখানে অধিকতর স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হয়। এসব মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা বেশি হয় এবং বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে অধিক সময় প্রয়োজন হয়। সে বিবেচনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও মামলার অনুপাতের পার্থক্য আরও কম হওয়া উচিত। মামলার জট ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে বিচারাধীন মামলার বিচারপ্রার্থীদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আরও অধিকসংখ্যক ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। ডেথ রেফারেন্স সারাদেশের আদালতগুলোতে মামলার জট থাকলেও মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) মামলাগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। গত ১২ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় নিষ্পত্তির হার ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তুলনামূলকভাবে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ সুপ্রীমকোর্টের প্রশাসনও কঠোরভাবে মনিটর করছে। সেকশন থেকে মামলার দ্রুত নথি দেয়া, পাশাপাশি পেপারবুক তৈরিতে যাতে বিলম্ব না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবীগণ জানিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হচ্ছে। শুনানির আগে তো পেপারবুক প্রস্তুত করতে হবে। কারণ পেপারবুক তৈরি করতে একটু সময় বেশি লাগছে। এরপর তালিকায় আসলে শুনানি শুরু হয়। কনডেম সেলে ফাঁসির আসামিরা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। তাদের অধিকার রয়েছে যাতে দ্রুত এসব মামলার বিচার শেষ হয়। কারণ যত দ্রুত নিষ্পত্তি হবে ততই মঙ্গল। উল্লেখ্য, কোন ফৌজদারি মামলায় নিম্ন আদালত কাউকে ফাঁসি দিলে ওই আসামির মৃত্যুদ-াদেশ অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা ও দায়রা জজ সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক দেয়া এই চিঠিতে ফাঁসির রায়ের অংশ বিশেষ তুলে ধরে বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে উক্ত মৃত্যুদ-ের রায় কার্যকর করার আদেশ হলো। তাই হাইকোর্টের সদয় অনুমোদনের জন্য মামলার কাগজপত্র, সিডি, মূল নথি ও যাবতীয় প্রসিডিংস পেশ করা হলো। এরপর রায়ের কপি প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে আসামিরা আপীল দায়ের করেন। পরবর্তীকালে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, নিম্ন আদালতের আদেশনামা ও রায়, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দী ও জেরা, সিআরপিসির ৩৪২ ধারা মোতাবেক অভিযুক্ত ব্যক্তির পরীক্ষা, আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, সুরতহাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, ফরেনসিক ও কেমিক্যাল রিপোর্ট, জব্দ তালিকা, খসড়া মানচিত্র ও সূচীপত্রসহ বিস্তারিত নথিপত্র যুক্ত করে বিজি প্রেস থেকে পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। এরপর মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়।
×