ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

সৌদি-ইরান সমঝোতার নেপথ্য চেষ্টা!

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সৌদি-ইরান সমঝোতার নেপথ্য চেষ্টা!

এবার হজ মৌসুমে একটা লক্ষণীয় ব্যাপার দেখতে পাওয়া গেছে যা থেকে আগামীতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটার ইঙ্গিত মিলতে পারে। সেটা হলো সৌদি আরবে ইরানী হাজীদের প্রতি সদয় আচরণ। মদিনায় আল-বাকি গোরস্তানে ইরানীরা কবর জিয়ারতকালে সুন্নি প্রহরীরা তাদের চোখ রাঙিয়ে ছিল, ভর্ৎসনা করেছেন। কিন্তু আগের বছরগুলোর মতো তাদের লাঠিপেটা করেনি। মদিনায় নামাজ আদায়কালে উত্তাপ থেকে তাদের স্বস্তি দিতে প্রহরীরা ফ্যান ছেড়ে দিয়েছিল। কাবায় মক্কার গবর্নর শাহজাদা খালিদ আল ফয়সাল ৮৬ হাজার ইরানীকে আলাদাভাবে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। এসব কিছু থেকে শিয়া ও তাদের রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরী সম্পর্কে একটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যেতে পারে। কয়েক দশক ধরে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ খারাপ যাচ্ছিল। ইরানী হজযাত্রীদের নিয়ে প্রতি বছরই কিছু না কিছু গোলমাল হয়ে থাকে। এবার তা হয়নি। হাজীর সংখ্যা এ বছর ২০ শতাংশ বাড়লেও বড় ধরনের কোন অঘটন ছাড়াই হজ সম্পন্ন হয়েছে। এ জন্য ইরান সৌদিদের ধন্যবাদও জানিয়েছে। ২০১৫ সালে সিংহাসন আরোহণের পর থেকে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ও তার পুত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব গায়ের জোরে খর্ব করার দিকে মনোনিবেশ করেন। তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ দখলকারী ইরান সমর্থিত হুজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়। ২০১৫ সালে মক্কায় পদদলিত হয়ে নিহত কয়েক শত ইরানী হাজীর জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। পরের বছর তারা উগ্রবাদী সৌদি শিয়া ধর্মীয় নেতা নিমর আল-নিমরের শিরোñেদ করেন। ইরানের সঙ্গে তারা কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং সুন্নি রাষ্ট্রগুলোর এক বিশাল ইরানবিরোধী সামরিক জোট গড়ে তোলেন। আজ দু’বছর হলো শাহজাদা মোহাম্মদ হয়ত নতুন করে সবকিছু ভাবছেন। গত জুন মাস থেকে তিনি আবার যুবরাজ হয়েছেন। সেই শাহজাদা মোহাম্মদ ইরানের মুখাপেক্ষী বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করার পরিবর্তে তাদের এবং সেই সঙ্গে তাদের পৃষ্ঠপোষক ইরানকে কাছে টানার চেষ্টা করছেন। ২৫ বছর আগে ইরাকের সঙ্গে ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৯০ সালের পর থেকে চলতি সেপ্টেম্বর মাসে এই প্রথম দু’দেশের সীমান্ত খুলে দিয়েছেন পণ্য ও লোক চলাচলের জন্য। গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের সংক্রান্ত একটা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সৌদি সেনাপ্রধানকে বাগদাদে পাঠিয়েছেন। ইরাকী বাণিজ্য প্রতিনিধি দলকে রিয়াদে আনিয়েছেন। জুন মাসে তিনি মেজমান হয়ে ইরাকের শিয়া প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদিকে স্বাগত জানিয়েছেন। জুলাই মাসে জেদ্দায় তাকে ইরাকের অন্যতম উগ্রপন্থী শিয়া ধর্মীয় নেতা মুক্তাদা আল সদরের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখা গেছে। সৌদি আরব ইরাকে শিয়া ইসলামের আধ্যাত্মিক রাজধানী নাজাফে কনস্যুলেট খোলার এবং সেখানে ইমাম আলীর মাজার জিয়ারতের জন্য হাজার হাজার সৌদি শিয়ার যাতায়াতের সুবিধার্থে সরাসরি ফ্লাইট চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন সাম্প্রদায়িকতা ফিকে হয়ে আসছে। এ অঞ্চল শান্ত হয়ে আসছে। তিনি সিরিয়া যুদ্ধ শেষ হয়ে আসার এবং আইএস খেলাফতের অবস্থার কথা উল্লেখ করেন। বস্তুতপক্ষে সিরিয়া প্রশ্নে সৌদি ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটছে। আগে সৌদি ধর্মীয় নেতারা ইরান সমর্থিত আলাওয়াইত ক্লানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সুন্নি মুজাহিদদের প্রতি আহ্বান জানাত। এখন সেই সুর নরম হয়েছে। শোনা যাচ্ছে যে শাহজাদা মোহাম্মদ সিরিয়ার সুন্নি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন এবং রিয়াদ প্রবাসী তাদের নেতাদের প্রেসিডেন্ট বাশার সরকারে সঙ্গে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। উত্তর ইয়েমেনে সৌদি বোমাবর্ষণ এখনও চলছে বটে তবে সেখানেও তাদের অধিকতর সমঝোতার সুর শোনা যাচ্ছে এবং একটা সমঝোতায় আসার আগ্রহ দেখাচ্ছে। ২৫ আগস্ট সানায় তাদের বোমাবর্ষণে ১৪ সিভিলিয়ান নিহত হলে তারা সে জন্য ক্ষমা চেয়ে বসে সেটা বেশ অস্বাভাবিক ব্যাপার। কিছু সৌদি কর্মকর্তা বলেন তারা ধর্মের চাইতে জাতিসত্তাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ইরানের আরব মিত্রদের কাছে টানতে চায় যাতে করে ইরানের প্রভাব খর্ব করা যায়। কিছু পর্যবেক্ষকের বক্তব্য হচ্ছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে একটা সমঝোতার চেষ্টা চলছে। এক মস্ত দর কষাকষি হচ্ছে যেখানে সৌদিরা সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের উত্তরাঞ্চলে ইরানের আধিপত্য মেনে নেবে এবং বিনিময়ে সৌদি আরব উপসাগরীয় দেশগুলো ও আরব উপদ্বীপে অবাধে আধিপত্যের সুযোগ পাবে। কিন্তু সমঝোতা যে চাট্টিখানি কথা নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শিয়া প্রধান ইরাকী নেতারা সহজে সৌদিদের আলিঙ্গন করবে এটাও মনে করার কারণ নেই। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×