ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ কথাকলি

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

 গল্প ॥ কথাকলি

ব্যালকনিতে সকালের রোদ। শীতের রোদের একটা বাড়তি আরাম আছে। পিঠটা সেদিকে দিয়ে ডান হাতে চায়ের কাপ ধরে বসে আছে রায়হান। পা দুটো আয়েশ করে সামনের ছোট টেবিলটার ওপর তোলা। বাঁ হাতে খবরের কাগজ। হেড লাইনগুলো দেখেই রেখে দেয় সে। ভিতরে কি লেখা থাকবে ধারণা আছে তার, দীর্ঘ দিনের পত্রিকা পাঠক হিসাবে। রাস্তায় গাড়ি, আর রিকশার জটলা চোখে পড়ছে। ফ্লাটটা আটতলায়। আলবারাকা টাওয়ার এর আট তলায় থাকে সে। অবজারভেটরি টাওয়ারের মতো চারপাশে কি ঘটছে সব দেখা যায় এখান থেকে। কাজের মেয়ে সালেহা সাত সকালেই দুটো আটার রুটি আর ঘন বুটের ডাল নিয়ে নাস্তা পরিবেশন করেছে। নাস্তা খাবার পর পরই তার দৈনন্দিন রুটিন হার্টের ওষুধ নিডোকার্ড, বিটালক, ক্লপিড খেয়ে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে বারান্দায় এসে বসেছে। এখানেই আয়েশ করে চা-টা খাবে সে। একটু পরেই সালেহা এসে খালি কাপ-প্লেটগুলো নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করে- : দুপুরে কি রানমু ভাইজান? : রোজ তুই আমারে জিগাস ক্যান? নিজে ইচ্ছা মতো রানবি। খালি একটু তেল কম দেবি। জানস তো আমার হার্টের অসুখ্ তারপর একটু থেমে বলে : গতরাতের তেলাপিয়া মাছের তরকারি আর করলা ভাজি আছে না? : হ, আছে। : তাইলে সঙ্গে একটু আলু ভর্তা আর ডাইল রাইন্ধা লইস। সঙ্গে সালাদ থাকতে হইবো। সালেহা চলে যায়। একটু পড়েই ব্যালকনি ছেড়ে উঠে আসে। সালেহাকে বাথরুমে গরম পানি দিতে বলে। এ বাড়িতে গিজার নেই। গোসলটা সেরে নিবে সে। সকাল থেকেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে। গত রাতে ক্যাথারিন এসেছিল। আশ্চর্য জীবন্ত ছিল সে। হাতে ছিল একটা লাল কালির বলপেন। সেটা দিয়ে ক্যালেন্ডারের ১৯ ডিসেম্বর সংখ্যাটার চারদিকে বৃত্ত একে বলেছিল - ঃ আজকে আমাদের ম্যারেজ ডে এনিভার্সারি, তুমি কি ভুলে গেছো? ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসেছিল সে বিছানায়। এখনো ঘুমের ঘোর কাটেনি। বেড রুমে ডিম লাইটের আধো আলো-অন্ধকারে চারদিকে হাত দিয়ে খুঁজেছিল সে তাকে। ধীরে ধীরে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল। সামনে দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের পাতাটা উড়ছে ফ্যান এর বাতাসে। পাতার মাঝখানে ১৯ তারিখটা দাঁত ভ্যাংচাচ্ছে যেনো তাকে। আজ পঁচিশ বছর ধরে সে একা। একটাই ছেলে ক্যানাডাতে পড়ছে। মাঝে মাঝে ফেসবুকে চ্যাট বা স্কাইপে মুখোমুখি দেখা হয়। সে ওখান থেকে ‘হাই পাপা’ বলে হাত নাড়ে। ওই পর্যন্তই। এর চেয়ে বেশি তার হৃদয়ের টান আছে বলে মনে হয় না রায়হানের। ক্যানাডায় সেও গিয়েছিল। ওখানে যাওয়ার জন্য পাগলই ছিল সে। এ জন্য ব্যাংক এশিয়ার পাকা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল। কোনভাবে সেখানে খাবার পথ খুঁজে না পেয়ে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্টুডেন্ট ভিসায়ই চলে গিয়েছিল সে। সেই ম্যানেজমেন্ট ক্লাসেই ক্যাথারিনের সঙ্গে দেখা। ক্যাথারিন অনটারিওর উত্তর সীমার হাডসন বের কাছ থেকে এসেছে। কয়েক দিনের মাঝেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো তার সঙ্গে। ভার্সিটির স্টুডেন্ট রেজিস্টার থেকে ওর বার্থ-ডেটা জেনে নিয়েছিল সে। তারপর তার জন্মদিনে ক্যাথারিনের হোস্টেলে হাজির হয়েছিল সে গুনে গুনে ছাব্বিশটি তরতাজা গোলাপ নিয়ে। ক্যাথারিন ফুলগুলো বুকের কাছাকাছি ধরে একটু প্রাণভরে লম্বা সুগন্ধী নিঃশ্বাস টেনে শুধু উচ্চারণ করতে পেরেছিল- : সো সুইট ! ওই দিনই ক্যাথারিনকে জয় করে নিয়েছিল সে। সে রাতে নাইট ক্লাবে তাকে দাওয়াত করেছিল ক্যাথারিন। তার অন্যদিনের সঙ্গী উইলিয়ামকে ছেড়ে শুধু রায়হানের বুকে মাথা রেখেই নেচেছিল ওই রাতে। কয়েক পেগ রঙিন পানি গলায়ও ঢেলেছিল তারা। দামটা রায়হান দিতে চাইলেও ক্যাথারিনের আপত্তিতে পারেনি। : ইউ আর মাই গেস্ট দিস নাইট। সো আই উইল পে। তাছাড়া তুমি আমার দেশে এসেছো, তুমি আমার দেশেরও গেস্ট। এর পর আর কথা বাড়ায়নি রায়হান, কিন্তু তক্কে তক্কে থেকেছিল কবে তার নিজের জন্মদিন আসবে। সেদিন ক্যাথারিনকে নিয়ে উজাড় হয়ে পালন করেছিল দিনটা। রাতে হোটেলের ডিনার টেবিলে ক্যাথারিনকে বলেছিল - : আই এ্যাম সো হ্যাপি। আই গট এ ফ্রেন্ড লাইক ইউ! ইচ্ছে হয় তোমার দু চোখের নীল সাগরে আমি চিরকাল অবগাহন করি। শুনে হা-হা করে হেসেছিল ক্যাথারিন। তারপর দুষ্টুমি করে তার গালটা টিপে দিয়ে বলেছে- : নটি বয়! ক্যাথারিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা এখানে যে দু-চারজন বাংলাদেশী ছেলেরা পড়ত তাদের কাছে গোপন থাকেনি। ওরা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো- : মেয়েটা ক্যানাডার সিটিজেন। ওটাকে গেঁথে নে দোস্ত। ওকে বিয়ে করতে পারলে তুই থিতু হতে পারবি এখানে। ওদের উৎসাহে বাদাম দেয়া নায়ের মতো ভেসে চললো রায়হান। এখন ভার্সিটির করিডর, সেমিনার, খেলার মাঠ, পার্ক, আনন্দ-অনুষ্ঠান সর্বত্র একসঙ্গে দেখা যায় তাদের। সেদিন দু-জনে মিলে ফাইভ-ডি মুভি দেখতে গিয়েছিল। ছবি তেমন না দেখে পাশাপাশি বসে গল্পই করে চললো ওরা ফিসফিস করে। রায়হান ক্যাথরিনের কানের কাছে মুখটা এনে ঘনিষ্ঠ স্বরে বললো - : জানো আমাদের দেশে একটা সুন্দর ড্যান্স ইভেন্ট আছে তার নাম ‘কথা কলি’। তুমি আমার ছন্দহীন ছন্নছাড়া জীবনে নৃত্যের ছন্দ এনে দিয়েছো, আজ থেকে তোমাকে আমি ক্যাথারিন নামে ডাকবো না, বলবো কথাকলি। : ওকে, এ্যাজ ইউ লাইক ইট। ক্যাথারিন সিনেমা স্ক্রীন থেকে চোখ দুটি ফিরিয়ে রায়হানের দু’চোখে নিবদ্ধ করে ওর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে উত্তর দিয়েছিল। দিনগুলো রঙিন প্রজাপতির মতো ডানা মেলল নীল আকাশে। এর মাঝে তাদের রেজাল্ট বের হয়েছে। পাশ করে দু’জন দুটো ভিন্ন ফার্মে চাকরি নিয়েছে। সুযোগ বুঝে বিয়ের কথাটা পেড়েছিল রায়হান- : তোমার বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করো, কলি। আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য পেতে চাই। : ইউ মিন ম্যারেজ! হোয়াই শুড আই আস্ক মাই প্যারেন্টস? ইট ইজ মাই লাইফ। এবসোলিউটলি মাই ডিসিশন। তারপর একটু থেমে বলল - : আই এ্যাম এগ্রিড, ডিয়ার। এতো সহজে ক্যাথরিনের দিক থেকে ব্যাপারটা সেরে যাবে বুঝতে পারেনি সে। কিন্তু রায়হান বাংলাদেশী। তার সামাজিক নিয়ম-কানুন অনেক বেশি, কোন অবস্থাতেই সে স্বাধীন নয়, এমনকি বিয়ের পরও নয়। অনুমতি চাইতেই বাবা-মা বেঁকে বসলেন : তোকে পড়তে পাঠিয়েছিলাম। ভালো না লাগলে ফেরত চলে আয়। যদি ওই নির্লজ্জ বিদেশিনী বিয়ে করিস তবে ওই কলংকিত মুখ দেখাতে ফেরত আসিস না। ধরে নিবো আমার ছেলে মরে গেছে। সে সময় ইন্টারনেট, ফেসবুক, মায় মোবাইলের প্রচলন ছিল না দেশে। বাবা চিঠি লিখেই জানিয়ে দিলেন তার পুরো মতামত। সে চিঠি চিঠিতো নয় যেন এটম বোমা। রায়হান হতাশ হয়ে আকাশের দিকে তাকালো। বেতফলের মতো রক্তাক্ত চোখে জমা হলো নীরব কান্না। বিক্ষিপ্ত মনে মতো কাটালো ক‘দিন। বন্ধুরা অবশ্য তাকে চাঙ্গা করে তুলতে উৎসাহ জোগাল - : ওই মেয়ে যদি বলতে পারে : ইট ইজ মাই লাইফ, তুই কেন পারবি না? তোর লাইফ, তোকেই গড়তে হবে। বাপ-মারা তাদের মান্ধাতা আমলের ধ্যান ধারণা নিয়ে থাকতে চান, থাকতে দে। তাদের বা অন্য কাউকে কিছু বলার দরকার নেই তোর। এরপর নিজের আর ক্যাথারিন এর কিছু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মোটামুটি হৈ-চৈ করেই বিয়েটা সেরে ফেললো সে। খবরটা কি করে যেনো দেশে পৌঁছতে আগে থেকেই এনজাইনা পেক্টোরিসের রোগী রায়হানের জেদী বাবার ম্যাসিভ হার্ট এটাক হলো যা থেকে তাকে আর সারিয়ে তোলা সম্ভব হলো না। বন্ধুরা টেলিগ্রামে আসা এ দুঃসংবাদটা চেপে গেলো বেমালুম। বিয়ের পরের প্রথম দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটতে লাগলো বন্ধু-বান্ধবের বাসায় আর হোটেলে খেয়ে খেয়ে। হার্ডসন বের তীরে ক্যাথারিন এর বাবা মি. গ্রীম এর বাড়িতেও কাটালো কিছুদিন। মিস্টার আর মিসেস গ্রীন খুবই অমায়িক মানুষ। কয়েক একর জমি নিয়ে বিশাল ফার্ম আছে তাদের গ্রামের বাড়িতে। লেখা পড়া বেশি নেই তবে আর্থিকভাবে সচ্ছল, সে সুবাদে সামাজিক মর্যাদাও আছে। যেখানেই যান বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বায়হানের পরিচয় করিয়ে দেন গর্বভরে - : দিস ইজ মাই সান ইন ল’ ফ্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার কাছে এক অজানা উজ্জ্বল বিদেশ। তার বন্ধু-বান্ধবদের অধিকাংশ তারই মতো ফার্মের মালিক। দুনিয়ার সব খবর রাখায় তাদের গরজ নেই। নিজেদের নিয়েই নিজেরা খুশী। : হাই। বলে তারা হ্যান্ডশেক করার জন্য আগ্রহভরে হাত বাড়িয়ে দেয়। রায়হান খুব স্মার্টভাবে সে হাত ধরে ঝাঁকুনী দেয়। কিন্তু মনে মনে শংকিত হয় : আমি যে কোন ফকিরের দেশ থেকে এসেছি তা তোমরা জানো না। কাহাঁতক আর বাইরে খাওয়া যায়? একটা নিজস্ব ঘরের জন্য আকুলি-বিকুলি করে তার মন। কিন্তু এই টরোন্টতে বাড়ি ভাড়া পাওয়া দুষ্কর। শেষ পর্যন্ত খুঁজে খুঁজে একটা স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান পেলো। দু’জনেরই পছন্দ হলো ওটা। তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লো তারা। হোক না ভাড়া তবু নিজের এ্যাপার্টমেন্ট। নিজস্বভাবে থাকার জন্য একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। ছোট্র বাড়িতে দু’জন কপোত-কপোতী। অফিসের পরে সময়টা ওদের কলকাকলিতে কি করে কেটে যায় টেরই পায় না। বিছানা, সামান্য কিছু ফার্নিচার, টিভি ইত্যাদি কেনা হয়েছে। রান্নার আসবাবপত্র এখনো জোগাড় হয়নি। তার আবশ্যকতাও টের পায় না তারা। খাবার সময় হলেই পাশের রেস্টুরেন্টে চলে যায় বা অফিস ফেরতা পথে রাতের জন্য কিছু কিনে নিয়ে ফিরে রায়হান। দুপুরের খাবার যার যার অফিসেই এটা সেটা খেয়ে কোন ভাবে সেরে নেয়। উইক এন্ডে কোথাও বেড়াতে গিয়ে খেয়ে আসে। কিছুদিন এভাবে চলার পর রায়হান উপলব্ধি করলো রোজ রোজ বাইরে খাওয়া সম্ভব না। অন্ততপক্ষে উইক এন্ডে ঘরে বসে দুটো ডালভাত খাবার জন্য মনটা তার নিভৃতে দারুণ পিপাসিত থাকে। ক্যাথারিনকে জানালোও সে তার ইচ্ছা। কিন্তু ক্যাথারিন গা করে না। কোন হা না কিছুই না বললেও এর মধ্যে সে একটা কুকুর জুটিয়েছে। নাম দিয়েছে পপি। রোজ সকালে ক্যাথারিন এখন ঘুম থেকে উঠেই পপিকে নিয়ে হাঁটতে যায়। ফেরত এসে একটা আপেল আর প্যাকেট দুধ খোলে তাতে কর্নফ্লেক্স ঢেলে খেয়ে নেয় ব্রেক ফাস্ট। তারপর অফিস ছুটে। রায়হান খেলো কিনা জানতে আগ্রহ দেখায় না। জিজ্ঞাসাও করে না। রায়হান একদিন অনুযোগ করে কথাটা তুলতেই ক্যাথারিন বললো- : ইউ আর নট কিড। আমার মতো দুধে কর্নফ্লেক্স ঢেলে খেয়ে নাও। দুপুর হলেই ক্যাথারিন তাগাদা দেয় - : আই এ্যম হাংগ্রী, লেটস্ গো। ‘গো’ মানে রেস্টুরেন্টে যাওয়া। রায়হানের মনটা বিষিয়ে ওঠে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। নীরবে ওকে অনুসরণ করে। যেতে যেতে মনে মনে ভাবে আপনি আচরিই অন্যকে শেখাতে হয়। সে এর পর থেকে উইক এ্যান্ডে নিজেই পাক করতে শুরু করে। তারপর দুপুরে দু’জনে মিলে পাশাপাশি বসে খায়। : ওয়াও। ইটস ফ্যানটাসটিক। খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠে ক্যাথারিন। : ইউ কুক সো নাইস। মন্তব্যে আপাতত খুশী হয় রায়হান এভাবে বেশ কিছুদিন চালালো সে কিন্তু একদিনও ক্যাথারিন বললো না -: দাও আজ আমি পাক করবো। শেষে রাগ করে একদিন পাক বন্ধ করলো রায়হান। সেদিন দুপুরে ক্যাথারিন দেখে ঘরের টেবিলে কোন খাবার সাজানো নেই। সে এদিক-ওদিক খুঁজে হাঁড়ি-পাতিলের ঢাকনা উল্টিয়েও দেখলো। না সব খালি। কোন রান্নাই হয়নি। আড়াল থেকে রায়হান সব লক্ষ্য করছিল। ভেবেছিল এবার ক্যাথারিন নিজ হাতে পাক করবে। তা না করে সে বের হয়ে গেলো। রায়হান বুঝতে পারল সে রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে। তবুও সে পাক করল না। এমন কি চেষ্টাও করল না। পরবর্তী উইক এন্ডেও রায়হান পাক করল না কিন্তু সেই একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি ঘটল। শেষমেষ তাকেও হোটেলের আশ্রয় নিতে হলো। অফিসে কাজের মনোযোগ হারিয়েছে রায়হান। ক্যাথারিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের বাহ্যিক কোন টানাপোড়েন নেই কিন্তু আজ পর্যন্ত স্ত্রীর হাতে রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হলো না তার। অফিসের ছাইপাশ গেলা আর ভালো লাগে না। আজ কাল লাঞ্চ আওয়ারে বাসায় চলে আসে। তবে দু’জনে একসঙ্গে আসতে পারে না। রায়হানের কাজের চাপ বেড়েছে। দুপুর আসতে দেরি হয়। বিরতির সময় ক্যাথারিন আগে বাড়িতে এসে কিছু একটা মুখে দিয়ে চলে যায়। কখনও বা বাড়ি এসে দেখে ক্যাথারিন একা একা পাক করে খেয়ে চলে গেছে। ওর জন্য কিছু রাখেনি। ওর স্ত্রী আবার খুব স্বাস্থ্য সচেতন। একবেলার খাবার অন্য বেলার জন্য বা পরে অন্য কেউ খাবে এজন্য তুলে রাখে না। সে বলে দেরি হলে গরম খাবার ঠা-া হয়ে ব্যাক্টেরিয়া জমে। মেজাজ খাট্টা হলে রায়হান মুখে কিছু না দিয়েই আবার অফিসে চলে যায় ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে। সেদিন এভাবে যখন যাচ্ছিল হঠাৎই মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় পথে। ক্যাথারিন কি কাজের জন্য যেন অফিস থেকে বাইরে বের হয়েছিল। ওর শুকনো চেহেরা দেখে জানতে চায় - : তুমি দুপুরে খাওনি? : না, রান্না করা ছিল না। নির্বিকারভাবে উত্তর দেয় সে। : নিজে রান্না করে খেয়ে নিলেই পারতে। ততোধিক নির্বিকারভাবে উত্তর দেয় ক্যাথারিন। : তোমাকে উপদেশ দিতে হবে না। জুতায় শব্দ তুলে গট গট করে চলে যায় রায়হান তার পথে। রায়হান অবশ্য যখন পাক করে সে কিন্তু দু’জনের জন্যই পাক করে তারপর ক্যাথারিনের ভাগটা তুলে রাখে। সেদিন অফিস ফিরেই রায়হান খুশীতে ডগমগ হয়ে ওঠে। যাক তার এতদিনের সাধনার ফল ফলেছে। মতি ফিরেছে ক্যাথারিনের। টেবিলের ওপর ঢাকা দেয়া খাবার। ভাত নয় মাংস দিয়ে অন্য কি রকম একটা খাবার বানিয়েছে সে। না হোক ভাত-তরকারি তবু বউ এর হাতে বানানো প্রথম খাবার। আল্লাহর প্রতি অপরিসীম শোকরিয়া জানায় সে। ক্যাথারিন এর জন্য এক অনাবিল ভালোবাসায় তার মন আপ্লুত হয়ে যায়। তার স্ত্রী লাঞ্চ টাইমে আগেই অফিস থেকে ফিরে পাক করে খেয়ে ওর জন্য খাবার তুলে রেখে তাড়াতাড়ি আবার অফিসে চলে গেছে। হয়তো কাজের চাপে ওর জন্য অপেক্ষা করার সময় পায়নি। আহা বেচারা খাটতে খাটতে শেষ হয়ে গেল বৌটা। আয়েশ করে ধীরে ধীরে খেতে শুরু করল সে। একটু পরেই ডোর বেলের শব্দ পাওয়া গেল। খাবার ছেড়ে উঠে যেয়ে দরজা খুলে দিল সে। সামনে ক্যাথারিন। তার ইচ্ছা হচ্ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় তার আগেই ক্যাথারিন সরব হয়ে ওঠে - : বসের এক আত্মীয় মারা গেছে, অফিসটা আজ আগে ছুটি হয়ে গেল তাই চলে এসেছি। রায়হান সে কথায় কান না দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে গেলো - : তুমি তো কখনো আমার জন্য কুকিং করোনি কিন্তু আজ করেছো তাই ভীষণ খুশী। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি বলতে পারল না রায়হান। কখনও আমার জন্য কুকিং করোনি বলতেই ক্যাথারিন কথাটা লুফে নিয়ে কণ্ঠ থেকে তূণ ছুঁড়ে দিল - : আই ক্যান্ট টেক ইয়োর বাংলাদেশী ভাত। আই কুক ফর মাইসেলফ এ্যান্ড... বাক্যটা শেষ করল না সে, তার আগেই তার দৃষ্টি পড়ল রায়হানের মুখ আর টেবিলের খাবারের দিকে - : একি, কি করছো তুমি? : কি করছি আবার? খাচ্ছি। এতো মজা করে জীবনে প্রথম তুমি আমার জন্য পাক করেছ, খাব না? ভাত লাইক করে না শোনার পরও মুডটা চাঙ্গা ছিল রায়হানের। কিন্তু এবার প্রতিউত্তর শুনে চমকে উঠলো সে। : নো, নো, ডোন্ট ইট ইট। : কেনো, কেনো খাবো না? : ইট ইজ ফুড ফর ডগ, আওয়ার পপি। তাহলে মহাসুখে এতোক্ষণ কুকুরের খাবার সে খাচ্ছিল ? কথাটা চিন্তা করতেই ঘৃনায় গা রিন রিন করে ওঠে। মুখে যতটুকু ছিল থু থু করে বের করে দিল রায়হান। তারপর এতো দিনকার জমে ওঠা মান-অভিমান শেষে রাগে গর গর করে উঠলো সে - : তুমি তাহলে আমার জন্য কুক করোনি? আমার জন্য পাক করলে কি ক্ষতি হয় তোমার? : কেন, কেন কুক করব তোমার জন্য? আই এ্যম ইয়োর ওয়াইফ, নট ইয়োর হাউস সার্ভেন্ট! তেমনি শ্লেষ মিশিয়ে উত্তর দিলো ক্যাথারিন। : আমি তাহলে তোমার কাছে কুকুরের চেয়েও অধম। ইউ ক্যান কুক ফর দি ডগ বাট ক্যান্ট কুক ফর মি। চেঁচিয়ে উঠল রায়হান। : ইউ ক্যান কুক ফর ইয়োরসেল্ফ বাট ডগ ক্যান্ট কুক ইটস ফুড। সমান তালে ঝংকার দেয় ক্যাথারিন। সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল সবকিছু। পরবর্তী সপ্তাহেই বিধ্বস্ত রায়হান সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দেশের ফ্লাইট ধরেছিল একা। কিন্তু তখনও জানত না ক্যাথারিনের জরায়ুতে অঙ্কুরিত হচ্ছে তার তিন মাসের সন্তান। পাঁচ বছর আগে মাও চলে গেছেন না ফেরার দেশে সড়ক, দুর্ঘটনায়। ব্যালকনিতে ধীরে ধীরে আঁধার জমা হচ্ছে তার একাকী জীবনের মতো। আটতলার ওপর থেকে নজরে আসে বাইরের মেইন রোড। রাস্তায় অনেক ছোট হয়ে আসা গাড়ি আর মানুষের চলমান স্রোত।
×