ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মন মাঝি তোর বৈঠা নে-রে, আমি আর বাইতে পারলাম না...

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৭ আগস্ট ২০১৭

মন মাঝি তোর বৈঠা নে-রে, আমি আর বাইতে পারলাম না...

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ খাল-বিল আর নদী-নালার দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এক সময়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের চলাচলের অন্যতম পথ ছিল নদী। সেই নদীপথে নৌকা ছিল প্রধান বাহন। নৌকা দিয়ে হাট-বাজারে যাওয়া, মালামাল আনানেয়া করা, আমদানি-রফতানি, নৌকা সাজিয়ে বরযাত্রাসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হতো। নৌকা হয়ে ওঠে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। দিন দিন কমে এসেছে সেই নৌকার ব্যবহার। তবু আজও নদীতে নৌকা চলতে দেখা যাচ্ছে হরদম। অনেক নৌকায় লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া। নৌকায় বসেছে ইঞ্জিন। এখন আর নৌকা আগের মতো ধীরে ধীরে চলে না, হয়েছে দ্রুতগতির বাহন। মাঝিকে বৈঠা হাতে নৌকা চালাতেও তেমন দেখা যায় না। তবে কোন কোন এলাকায় এখনও নৌকায় বৈঠার ব্যবহার হারিয়ে যায়নি। চলছে নানান ধরনের নৌকা। কোন কোন এলাকায় এখনও খেয়া নৌকায় ব্যবহৃত হচ্ছে বৈঠা। যা মাঝি নিজ হাতে চালাচ্ছেন। এদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল যেমন ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, ছই, পাতাম, বাচারি, রফাতানি, ঘাসি ও সাম্পান। নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো শুরু হয়। ফলে নৌকা একটি যান্ত্রিক নৌযানে পরিণত হয়। এ যান্ত্রিক নৌকাগুলো শ্যালো নৌকা নামেও পরিচিত। আধুনিক যুগেও অনেক ঘাটে এখনও ছইওয়ালা বা ছাউনিওয়ালা নৌকা চলতে দেখা যায়। ছইওয়ালা নৌকা এখনও মাঝিরা বৈঠা বেয়ে ধীরে ধীরে নদী পার করেন। শৌখিন মানুষজনকেও সেই বৈঠাওয়ালা নৌকায় চড়ে মনের আনন্দে নদী পার হতে দেখা যায়। ছইওয়ালা নৌকা দিয়ে এক সময়ে গ্রামগঞ্জের নববধূদের বা বউদের নাইওর হিসেবে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি আনানেয়া করা হতো। তখন মাঝি-মাল্লারা মনের আনন্দে বৈঠা বাইত আর বিভিন্ন ভাটিয়ালী, মুর্শিদী ও মারফতি গান গেয়ে ক্লান্তি দূর করত। তাদের সুর নৌকার যাত্রীদেরও মন কেড়ে নিতো। তখন মাঝিদের মুখে শোনা যেত ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না; তুমি বেশ বদলে গেছ...পুরনো সৈকতে আর পানসি ভেড়াও না’ এ ধরনের নানান গান। এখনও ছইওয়ালা নৌকা দিয়ে বিভিন্ন নদীতে লোকজনকে নদী পারাপার করতে দেখা যাচ্ছে। প্রাচ্যের ডা-িখ্যাত নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর বিভিন্ন খেয়াঘাটে এখনও বৈঠাযুক্ত ছইওয়ালা নৌকা দিয়ে নদী পারাপার করছেন মাঝিরা। এখানকার মাঝিরা ছইওয়ালা নৌকার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই শীতলক্ষ্যার বক্ষে ছইওয়ালা নৌকা চলতে দেখা যায়। আলী আহমেদ (৩৫) দীর্ঘ ১২-১৩ বছর ধরে শীতলক্ষ্যার সেন্ট্রাল খেয়াঘাটে ছইওয়ালা নৌকা চালিয়ে জীবন ধারণ করছেন। এটাই তার পেশা। তিনি ভোর হলেই ছুটে আসেন খেয়াঘাটে। তার আদি বাড়ি চাঁদপুর শহরে, থাকেন বন্দরের রেললাইন এলাকায়। প্রতিদিন ছইওয়ালা নৌকা বেয়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা আয় করেন। এ আয় দিয়েই তিনি তার সংসার চালাচ্ছেন। প্রতিবার তিনি ৩০ টাকা করে আয় করতে পারেন। তার নৌকায় ৫-৬ জন যাত্রী উঠাতে পারেন। তিনি নৌকাটি ভাড়া চালান। প্রতিদিনের আয় থেকে নৌকার মালিক মান্নান গাজীকে ভাড়া হিসেবে দিতে হয় একশ টাকা। সারাদিন চালালে ভাড়া গুনতে হয় দু’শ’ টাকা। তখন তার আয়ও বেড়ে যায়। তারা শীতলক্ষ্যা নদী প্রতিজনকে পাঁচ টাকায় পার করেন। এখানকার অধিকাংশ মাঝি হতদরিদ্র। তাই তাদের নৌকা কেনার সামর্থ্যও নেই। মহাজনের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া এনে চালান। বন্দরের কলাগাছিয়া এলাকার যাত্রী সাইফুল ইসলাম জানান, সময় পেলেই তিনি হাতে বৈঠা বাওয়া নৌকা দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হন। তিনি জানান, সময় লাগলেও তাতে কি? ঐতিহ্যবাহী ছইওয়ালা নৌকায় শখেরবশে পার হচ্ছি। এতে কিছুটা সময় ব্যয় হলেও শীতলক্ষ্যার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। জামান মিয়া (৫৫) একই ঘাটে ১৭ বছর ধরে ছইওয়ালা নৌকা চালাচ্ছেন। প্রতিদিন তিনি ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা আয় করেন। তার মতে, এই ঘাটে শতাধিক ছইওয়ালা নৌকা দিয়ে লোকজনকে পার করা হয়। তিনি জানান, সকাল সাতটা থেকে ১০টা এবং বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিনি জানান, বন্দরের জামাইপাড়া, বারিপাড়া, রূপালী, আমিনপাড়া, রেললাইন, চৌধুরীবাড়ি, কলাগাছিয়া, কল্যান্দি, মদনগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন প্রতিদিন নৌকা দিয়ে পারাপার হন। ঢাকার বিভিন্ন অফিস-আদালতের লোকজনও শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে কিংবা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক পথে চলাচল করছেন। একই ঘাটের আরেক মাঝি হারুন মিয়া জানান, ছইওয়ালা নৌকা যাত্রীকে রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ মানুষ শীতলক্ষ্যা নদী পার হচ্ছে।
×