ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নুরুল করিম নাসিম

জার্নাল ॥ পুরনো বইয়ের গন্ধ

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১১ আগস্ট ২০১৭

জার্নাল ॥ পুরনো বইয়ের গন্ধ

আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির কিছু বইপত্র ঢাকার বিভিন্ন পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা। এই বইগুলো দুর্লভ এবং এখন আর পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে নির্দিষ্ট র‌্যাক থেকে এই বইগুলো বের করে পাতা ওল্টাতে ভাল লাগে। পুরনো বইয়ের গন্ধে মন আকুল করে তোলে কখনও কখনও। ঢাকার পুরনো পল্টনের পানির ট্যাঙ্কের উল্টো দিকের গলিতে বেশ ক’টি পুরনো বই ও ম্যাগাজিনের দোকান ছিল। রথখোলা মোড়ে পতিতাপল্লীর উল্টো দিকে সাধনা ঔষধালয়ের সিডির ওপর একটি অবাঙালী লোক পুরনো বইপত্র বিক্রি করতেন। এখন পতিতাপল্লীও নেই, সেই দোকানটিও নেই। বাংলাবাজারেও দু-একটি পুরনো বইপত্রের দোকান ছিল। অনেক দিন এসব দোকানে যাওয়া হয় না। সে সব দোকান এখন আছে কিনা জানি না। খুব বেশি যেতাম রথখোলা মোড়ের অবাঙালী লোকটার দোকানে। সেখানে পূজা সংখ্যা দেশ, উল্টোরথ এবং আরও অনেক ম্যাগাজিন ও বই পাওয়া যেত। এখনও অবাঙালী লোকটার কথা খুব মনে পড়ে। তিনি বাংলা-উর্দু মিলিয়ে একটি জগাখিচুরি ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলতেন। সেটা ছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দিন দিন এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে জমা হচ্ছে। দেশ শাসন করছেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। তিনি ১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে কলকাতার বাংলা পত্রপত্রিকা এ দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, রথখোলার মোড়ের এই পুরনো বইয়ের দোকানে কলকাতার পত্রিকা এবং বই পাওয়া যেত। কে বা কারা এনে সেই অবাঙালী লোকটির কাছে এসব বিক্রি করে যেত, সে বিষয়ে তাকে আমি কখনও কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করিনি। লোকটি সারাক্ষণ উর্দু ম্যাগাজিন পড়তেন। চোখে কালো চশমা, মুখে সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পান খাওয়া লাল দাঁত। তার মুখের মতো মলিন ফতুয়া আর লুঙ্গি। পঞ্চাশের বেশি বছর পার হয়ে গেছে। অথচ এখনও তার চেহারা মনে পড়ে। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির পুরনো বইয়ের পাতায় হাত রাখলেই তার কথা মনে পড়ে। বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম লেখকদের কালজয়ী সব গল্প-উপন্যাস আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি। দাম খুব একটা বেশি দাবি করেননি, আবার খুব যে কম নিয়েছেন, তাও নয়। অনেকদিন তার দোকানে না গেলে তিনি না আসার কারণ জানতে চাইতেন। বেশকিছু দুর্লভ বইপত্র, যা তিনি আমার জন্য আলাদা করে রেখেছিলেন, তা এগিয়ে দিতেন। আমাদের উভয়ের মাঝে একটা চমৎকার সম্পর্কের সেতু গড়ে দিয়েছিল এসব পুরনো বইপত্র। এখনও চোখ বুঝলে, কখনও কোন অলস মুহূর্তে লোকটির মুখ আমি দেখতে পাই। অনেকের কাছ থেকে পুরনো বইপত্র কিনেছি, কিন্তু সবার কথা, সবার স্মৃতি মনে দাগ তেমনভাবে কাটেনি। যেমনটি রথখোলার বই বিক্রেতার স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে। তখন আমি স্কুলের ছাত্র। নতুন বই কেনার মতো সমর্থ, সুযোগ ও পয়সা হাতে ছিল না। অগ্যতা পুরনো বইয়ের দোকানই ছিল একমাত্র ভরসা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রুচি বদলাতে থাকে। পুরনো বইয়ের দোকান আমাদের চাহিদা পূরণ করতে তেমন একটা পেরে ওঠে না। আমাদের হাতে তখন টাকা পয়সা আসতে শুরু করেছে। আমরা চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু বইয়ের নেশা কমে না। পাঠাভ্যাস আগের মতো থেকে যায়। বরং আরও বহুগামী হয়ে ওঠে। আমার পাঠাভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাঠক থেকে একদিন লেখকে রূপান্তরিত হই। বই পড়ার কোন বিকল্প কিছু পাই না। প্রযুক্তি আসে, অনলাইনে বই পাওয়া যায়, কিন্তু বই কেনার অভ্যাস কমে না। একদিন দেশ স্বাধীন হয়। রথখোলার সেই লোকটিকে আর দেখি না। চারদিকে পতাকা দেখি, স্বাধীনতা দেখি, কিন্তু সেই লোকটিকে আর কোথাও দেখি না।
×