ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তোমাকে নিয়ে লিখতে হচ্ছে এটাই আমার কষ্ট বদরুল হায়দার

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১১ আগস্ট ২০১৭

তোমাকে নিয়ে লিখতে হচ্ছে এটাই আমার কষ্ট বদরুল হায়দার

খোন্দকার আশরাফ হোসেন তার চলে যাবার পর আমাকে লিখতে হচ্ছে এটাই আমার কষ্ট। তিনি একাধারে কবি, অধ্যাপক, অনুবাদক ও সম্পাদক হিসেবে তার জায়গাটুকু রেখে যেতে অবিরত কাজ করেছেন। বয়সে একটু বেশি সময়ে কবিতার সঙ্গে তার আত্মীয়তা হলেও কবি হিসেবে নিজস্ব নির্মাণে গভীর মনোযোগী ছিলেন। ফলে প্রথম কাব্যগ্রন্থ তিন রমণীর ক্বাসিদা ‘প্রকাশের মাধ্যমে সমকালীন কবি ও কবিতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন।’ ‘পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি অহঙ্কার আমার কবিতা বিষাদে বিশ্বাসে পূর্ণ হৃদয়ের জলাধারে ধরো আমাতে নিবন্ধ হও পুর্ণপ্রাণ ফলবন্ত হও আমাকে পাবে না ফলে, পরাগ-নিষিক্ত হও পাবে’ তিন রমণীর ক্বাসিদা কাব্যগ্রন্থে কবির আত্মঅহঙ্কারের তীব্র আকাক্সক্ষা ফুটে ওঠে। বয়সী তরুণের আবেগ উচ্ছ্বাস কাব্যিক উন্মাদনার অন্তর্মুখী জীবনবাদী এ কবি কাব্য জীবনের শুরুতে পূর্বসূরিদের কবিতা দ্বারা প্রভাবিত হন। পরবর্তী সময়ে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন। অনেকাংশে সফলতাও এসেছে। ৬২ বছর বয়সকালে তিনি একজন সফল অধ্যাপক, অনুবাদক, সমালোচক প্রবন্ধকার হিসেবে পরিচিত থাকলেও মানুষ তাকে কবি হিসেবেই বেশি চিনতেন। সম্পাদনায় ছিল তার সিদ্ধহস্ত। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তার সম্পাদনায় বের হয় ‘একবিংশ’ কবিতার কাগজ। মধ্য আসিতে একবিংশ শুরু করলেও ইতোমধ্যে একবিংশ বাংলাদেশে লোক নিটলম্যাগ পুরস্কার, পশ্চিম বাংলায়ও ছোট কাগজ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। ’৮০-এর দশকের স্বৈরাচারবিরোধী চেতনার উন্মেষ ও জাগরণের শুরুর দিকে খোন্দকার আশরাফ হোসেন একবিংশ (নতুন প্রজন্মের পত্রিকা) নামে কবিতার কাগজ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। মধ্য আশিতে আমরা কবি বন্ধুরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পাঠক ও সদস্য হিসেবে সন্ধ্যায় আড্ডায় জড়ো হতাম। তখন খোন্দকার আশরাফ আসতেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চায়ের আড্ডায় তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমি তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সের ছাত্র। জানতে পারলাম তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তখন বন্ধুদের মধ্যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আড্ডায় আসত আজাদ, নোমান, শোয়েব সাদাব, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, শান্তনু চৌধুরী, সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সৈয়দ তারিক, হোসেন হায়দার চৌধুরী, তপন বড়ুয়া, সেলিম মোর্শেদ, মিজান রহমান, বাহার রহমান, রিফাত চৌধুরী, কাজল শাহনেওয়াজ, পুলক হাসান, আহমেদ মুজিব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোহাম্মদ কামাল, শামসুল কবির কচি, অসীম কুমার দাশ, সরকার মাসুদ, সানোয়ার মনি, হাসানুল বান্না, ময়মনসিংহ থেকে আসতেন শামসুল ফয়েজ, মাহমুদ কামাল, নাসরিন জাহানসহ সমকালীন কবি লেখক গল্পকার ছড়াকার প্রবন্ধকারসহ অনেকে। ’৭০-এর দশকের কবিদের মধ্যে মোহাম্মদ সাদিক, ফরিদ কবির, শেখর বরবা, আবিদ আনোয়ার, আজিজ, তুষার দাশ, সাইফুল্লা মাহমুদ দুলাল, আলমগীর রেজা চৌধুরী, হাবীবুল হাসান, সাবদার সিদ্দিকী, রতন মাহমুদ, আবু হাসান শাহরিয়ার, কামাল চৌধুরীসহ অনেকে। আসতেন কেন্দ্রে ৬০ উজ্জ¦ল কবিরা। বেলাল চৌধুরী, কবি রফিক আজাদ, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শামসুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিক, কাজী রোজী, খালেদা এদিব চৌধুরী, রুবী রহমান, সিকদার আমিনুল হক, ফারুক মাহমুদ। ৫০ কবিদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক আসতেন নানা অনুষ্ঠানে। আহমাদ মাজহার তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরা কবি বন্ধুরা সারাদিনের রুটিন শেষে ৩টার পর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে লাইবে্িরর, ক্যান্টিন, অডিটরিয়াম, কখনও সামনের সবুজ কার্পেটে আড্ডা দিতাম। সন্ধ্যার পর আমতলায় ক্যান্টিন ঘিরে আমরা আড্ডায় জড়াতাম। মাঝে মাঝে খোন্দকার আশরাফ হোসেন আসতেন তরুণদের কাব্যিক আড্ডায়। আড্ডার কারণে তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এক সময় আশরাফ ভাই বললেন আসেন আমরা একটি কাগজ বের করি। একদিকে কবি হওয়ার বাসনা, অন্যদিকে কবিতার কাগজের সম্পাদনা সহযোগী। সব মিলিয়ে আমি কথা দিলাম। সম্পাদনার সঙ্গে থাকার। ঙেই কথা সেই কাজ। শুরু হলো নাম নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। নাম ঠিক হলো একবিংশ (নতুন প্রজন্মের পত্রিকা) প্রচ্ছদশিল্পী প্রচ্ছদ দিয়ে গেলেন। প্যাপিরাস প্রেসে লোহাগুলো টাইপ দিয়ে ভেতর অংশ ছাপা হলো সাদা কালোতে। প্রচ্ছদটির জিঙ্ক ব্লকে দুই রঙে ছাপা হয়। ছাপার মান, নির্ভুল বানান, তারুণ্যের চিন্তা, নতুন কবিতা, কবিতা নতুন ধারণা নিয়ে একবিংশা কাগজটির যাত্রা শুরু ছিল। আশাবাদী। একই সময়ে আজাদ নোমান সম্পাদিত চর্চাপদ। তপন বড়ৃুয়া সম্পাদিত গাম্ভীর প্রকাশিত হয়। একই সময়ে রিফাত চৌধুরী কাজল শাহনেওয়াজ, খায়রুল হাবীব, পুলক হাসানসহ অনেকের কবিতা নিয়ে কবি নামে আরেকটি কাগজও বের হয়। একবিংশ কাগজটি প্রকাশনা কিছুকাল আগে পারভেজ হোসেন ও শহীদুল আলমের সম্পাদনায় সংবাদ পরের বছর হাবীব ওয়াহিদ বের করেন অনিন্দ্য। ’৮৫ সালে বের হয় একবিংশ। ইতোমধ্যে রিফাত চৌধুরী ও সরকার মাসুদ সম্পাদিত নিভৃতচর্চা ছোট কাগজটি কয়েক সংখ্যা বের হয়। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ও আমি একদিকে কাগজটি নিয়মিত বের করতে থাকি। ’৮৭ সাল স্বৈরশাসনের উত্তাল সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা উৎসব করার চিন্তা করেন। যথারীতি একবিংশ আয়োজিত জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্যোগও ঘোষণা দেন। উৎসব বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার পশ্চিম পাশে চায়ের স্টলে খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আমি ও আজাদ নোমান চা খেতে খেতে উদযাপন কমিটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি। তার আহ্বানে আজাদ নোমান ও আমি চিঠি তৈরি করি, দাওয়াত দিতে থাকি। একই সময়ে স্বৈরাচারী সরকারের ছত্রছায়ায় এশিয়ান কবিতা উৎসবের আয়োজন চলে। সেই মুহূর্তে খোন্দকার আশরাফ হোসেন শামসুর রাহমান ভাইকে আহ্বায়ক হওয়ারও প্রস্তাব দেন। কবি শামসুর রাহমান অগ্রজ কবি ও সমকালীন কবিদের নিয়ে প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসব ৮৭ আয়োজনের উদ্যোগে একাত্মতা প্রকাশ করেন। অগ্রজ কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, রবিউল হুসাইন, ফারুক মাহমুদ, সমুদ্র গুপ্ত। মুহম্মদ নুরুল হুদা, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সোহেল রায়হান হারুন। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, মোহাম্মদ সামাদ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, তারিক সুজাত, ইশতেকবাল হোসেনসহ অসংখ্য কবিকে নিয়ে প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসব ’৮৭ অনুষ্ঠিত হয়। শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা সেøাগানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটি চত্বরকে দুই দিন ব্যাপী জাতীয় কবিতা উৎসবের সূচনা হয়। প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবে উদযাপন কমিটিতে খোন্দকার সাযযাদ হোসেন ছিলেন তথ্য সংরক্ষণ আহ্বায়ক। আযাদ নোমান ও আমি ছিলাম তথ্য সংরক্ষণ সচিব। একবিংশ কবিতার কাগজ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও তারুণ্যের জন্য পাটাতন সৃষ্টির ঘোষণা দিয়ে শুরু করলেও ক্রমেই প্রবীণ-নবীণ-তরুণ কবিদের লেখা প্রকাশ ও তারুণ্যের অনুপস্থিতির ফলে ১০ বছর পূর্তির আগেই আমি সহযোগী হিসেবে একক ও পরে সৈয়দ তারিকসহ সেই সহযোগী সম্পাদক থেকে নাম তুলে নিই। সেই থেকে গত ২৫ বছর প্রকাশনার ধারাবাহিকতায় আমার কোন রচনা প্রকাশিত হয়নি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কবি ও সম্পাদক হিসেবে। দীর্ঘ এক যুগের কাছাকাছি সময় একত্রে একবিংশ সম্পাদনার সুবাদে অজস্র সময় তাঁর ডিপার্টমেন্ট রুমে অথবা বাসায়। কখনও শিক্ষক লাউন্স, শিক্ষক ক্লাবে একত্রে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে। মানুষ হিসেবে খোন্দকার আশরাফ হোসেন ছিল প্রকৃতির প্রিয়তাভরা মানুষ। ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র পরবর্তীতে অধ্যাপক হিসেবে সফল মানুষের কাতারে তিনি ছিলেন প্রকৃতজাত কবিসত্তায় অন্তর্মুখী মগ্ন মানুষের প্রতিকৃতি। সার্বক্ষণিক কবি প্রতিভার স্ফূরণ রয়েছে তার কবিতায়। ফলে মিথ পুরাণ ঐতিহ্য কৃষ্টি আধুনিক ও লোক শব্দাবলীকে স্বার্থকভাবে কবিতায় স্থাপন করে মর্মার্থের প্রকাশে উৎসাহী ছিলেন। সার্বক্ষণিক কবিসত্তার স্ফূরণ রয়েছে তার কবিতায়। দেশী ও আন্তর্জাতিক কবিতার পাঠ, রয়েছে তার প্রাচ্যতায়। সহযোগী লেখক ও পাঠক হিসেবে কবিতাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। কবিও কবিতা বিষয়ে তার জানার রাজ্য ছিল সমৃদ্ধ ও বিশাল। কাব্য জীবনের শুরুর দশকে তার কাছাকাছি থাকার কারণে অসংখ্য কবিতা পাঠেরও তা স্বকণ্ঠে শোনার সুযোগ হয়েছে। সেই সময়ের তার রচিত অধিকাংশ কবিতার প্রথম পাঠক। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পার্থ তোমার তীব্রতার কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের আগেই সব কবিতা পা-ুলিপিতেই পড়ে ফেলি। জীবনের সমান চুমুক’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা নির্বাচনে আমি ছিলাম তার একমাত্র সঙ্গী। মানুষ কবিতা পড়ে আমি কবিতা গ্রন্থের শুরুতে ছাপার অনুরোধ করি। আশরাফ ভাই মানুষ কবিতা গ্রন্থের ১ম কবিতা হিসেবে প্রকাশ করেন। ‘মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না একদিন মানুষ নিজ হাতে নিজেকে পোড়াবে’ তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পার্থ তোমার তীব্র তীর গ্রন্থে কবির কাব্যশক্তি ও প্রজ্ঞার বহির্প্রকাশ ঘটে তীব্র আশাবাদী প্রত্যয়েÑ ‘কিন্তু আমি অন্যরকম পার্থ আছি আমার রথের শীর্ষদেশে যে পতাকা ছিঁড়তে পারো এমন আশা সিস্ফলতা তোমরা বামন হ্রস্ব খাটো, তোমাদের ওই মাপের কাঠি একটু ছোট আমার জন্য, তোমাদের ওই ঘরের কপাট বড়ই নিচু, আমি একটু দীর্ঘদেহী আমার ঘরের ছাদটুকু তাই করে নিলাম একটু উঁচু’ দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিব্যক্তির নিজস্ব উচ্চারণের প্রচেষ্টা তাকে আলাদা করেছে সমকালীনদের চেয়ে। আপাত দৃষ্টিকোণের বাইরে প্রাতিস্বিকতা, পরিপেক্ষিত নিয়ে নানাভাবে নাড়াচাড়া করেছেন। সর্বপরিব্যাপ্ত আকাক্সক্ষার কাছে দুঃখের স্বতন্ত্র সন্ন্যাসে প্রগাঢ় অভিমানের ছোঁয়া তাকে উদাসী ও সাহসী করে তোলে। প্রথমদিকের কাব্যগ্রন্থের চেয়ে সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর, যমুনা পর্ব, জন্ম বাউল, তোমার নামে বৃষ্টি নামে, আয়না দেখে অন্ধ মানুষ, কুয়াশার সুশায়েরা ও কবিতা সংগ্রহে কবি জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়েছেন আত্মদ্বন্দ্বময় সংঘাতে। তার জীবনাচার, দৃষ্টিভঙ্গিী, অর্জনের সানন্দ ও বিফল হওয়ার কষ্টের কাছে কখনও নতি স্বীকার করেননি। স্বভাবজাত খাঁটি বাঙালী হিসেবে এ ভূমির জলবায়ু আলো বাতাসে বেড়ে উঠলেও তার কবিতায় আন্তর্জাতিকতার স্পর্শ রয়েছে। বিশ্বসাহিত্য পঠন-পাঠনের বাইরে মানুষের আবেগ বিবেককে কবিতায় স্থাপন করেছেন সচেতনভাবে। প্রকৃতির রূপ রস, রং ও মহিমাকে কবিতায় নানাভাবে প্রয়োগের আগ্রহী ছিলেন। আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা, বিপন্নতা ও অভিন্নতাকে কল্পনার রসে সিক্ত করে কল্পনার অভিঘাতগুলোকে পরিমিতি শোধের সংযোগ বহুমাত্রিক করে তোলে। প্রেম প্রকৃতির অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মিলনের স্বপ্নময়তাকে হৃদয়ের আকুলতা দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সত্য সুন্দর ও পরিবর্তনের সপক্ষে আজীবনই লড়েছেন। আমৃত্যু কবি সত্তা দিয়েছে তাকে সম্মান। অসংখ্য পাঠক রয়েছে তার। গ্রামীণ জীবনের প্রতি স্নেহ মমতা আকুতি রয়েছে শৈশব-কৈশরে। গ্রামীণ জীবনে বেড়ে ওঠার কারণে পল্লী প্রকৃতির অপরূপ কমল না, পরিণত যৌবনে ঢাকা ইটের দালানের চিলেকোঠাও যানজটের কবলে শত অভিজ্ঞতার শিক্ষা তিনি কবিতায় স্বভাবজাত স্বাভাবিকতায় নিয়ে এসেছেন। যদিও দূরনীরিক্ষা অনুভবের আকৃতি রয়েছে জীবন চরিতে। চিরকালই বাড়ি ও নাড়ির টান অনুভব করছেন চেতনায়- বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বের দূরগামী পথ বাড়ি যাবো বাড়ি... ’৮০-এর দশকের সমসাময়িক কবিদের মধ্যেও তিনি ছিলেন চলমান ও গতিশীল কবিতাপ্রেমিক। কবিতাকে জীবনের অংশ হিসেবে নিয়েছেন আজীবন। কবিতার বাইরে প্রবন্ধ নিবন্ধ, সমালোচনা ও বিশ্বসাহিত্যের নানা বিষয় অনুবাদ করেছেন অসংখ্য। নিজের কবিতার অনুবাদ করেন ঙহ ইবযঁষধং জধভঃ নামে সফোক্লিস, ইউরোপিভিসের নাটক, টেরি ইগলটনের সাহিত্য তত্ত্ব, এডিথ হ্যামিল্টনের মিথোলজির তর্জমা বাংলায় অনুবাদ করেন। ইংরেজীতে অনুবাদ করেন ঝবষবপঃবফ ঢ়ড়সংড়ষ ঘরৎসড়ষবহফঁ এড়ড়হ ঋড়ষশ ঢ়ড়বসং ঋড়ৎস ইধহমষধফবংয, ঋড়ষশ ঞধষবং ভৎড়স ইধমষধফবংয, গ্রন্থ দুটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া গড়ফবৎহরংস ধহফ ইবুড়হফ ডবংঃঃবৎহ ফৎভষঁপহপব ড়হ ইধহমষধফবংযর ঢ়ড়বঃৎু নামে বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিক ও উত্তরাধুনিকতা নিয়ে বইটি প্রকাশিত হয় এবং একই বিষয়ে তিনি পিএইচডি গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কবিতা অন্তরঙ্গ অবলোকন, চিরায়ত পুরাণ, বিশ্ব কবিতার সোনালি শস্য। গ্রন্থগুলো তার সমকালে পাঠকের আপন করে তোলে।। এ ছাড়া বাংলাদেশের কবিতা অন্তরঙ্গ অবলোকন, চিরায়ত পুরাণ, বিশ্ব কবিতার সোনালি শস্য। গ্রন্থগুলো তার সমকালে পাঠকের আপন করে তোলে। বইমেলার পর আর দেখা হয়নি। মাসখানেক আগে কবি আহমেদুল বারী, টেলিফোনে জানাল কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে যোগদান করেছেন। আশাও ছিল নজরুল জন্মবার্ষিকীতে ত্রিশাল গেলে তার সঙ্গে দেখা করব। নজরুল মেলায় এবার যাওয়া হয়নি। ফলে তার সঙ্গে জীবিতকালে আর দেখা হয়নি। জন্ম-৪ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে জামালপুরে জন্ম নিয়েছেন। আবার নিজ জন্মস্থান বৃহত্তর ময়মনসিংহের ত্রিশাল কাজী সিমলার নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি হিসেবে অসুস্থ হন। পরে ১৬ জুন ২০১৩ ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ৬২ বছর বয়সে হঠাৎ এভাবে না ফেরার দেশে চলে যাবেন তা ভাবতে পারিনি। প্রকৃত অর্থে কবির কখনও প্রস্থান হয় না। কবিও কবিতা চলমান। তিনি আছেন এবং আছেন তার সৃষ্টিশীলতায়। তার কবিতার সঙ্গে ইতিহাস ঐতিহ্য রাজনীতি ও সামাজিক রীতিনীতির বিদগ্ধ চিন্তন রয়েছে। আমিত্ব অস্তিত্ববাদ, সুফীবাদের সত্যানুসন্ধান কবিতার উপাদান, লক্ষণ ও বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছেন দূরদৃষ্টিতে। প্রেমিক কবি হিসেবে প্রেমের দু’মুখী প্রবণতা প্রাণদানে সোচ্চার ছিলেন মানবিক প্রেমে। ‘যেখানে আমার জন্য ঘুমের বিছানা পাতা সেখানে এক নম্র চাষি বউ তাঁকে শাওনে আমার আহ্বান জানালো বহুমাত্রিক জীবনের আবরণের বাইরে অন্তগামী এক কবি প্রতিভা, তার কবিতা কবিতাপ্রেমী, কাব্য পাঠকের ভাল লাগবে এটাই বিশ্বাস। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মহাপ্রস্থান সময় সমাজ, কাব্য প্রেমিকদের জন্য একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়।
×