ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অটোরিক্সাচালক স্বপ্নার চোখে এখন ভিড় করেছে স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৪ জুন ২০১৭

অটোরিক্সাচালক স্বপ্নার চোখে এখন ভিড় করেছে স্বপ্ন

রাজুমোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে ॥ অদম্য সাহসী। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অনবদ্য চেষ্টা। গ্রামের মোল্লাদের তোয়াক্কা না করে সন্তানদের বাঁচানোর তাগিদেই বাড়ি থেকে বের হয়েছে স্বপ্না রানী। সে এখন নিজেই অটোরিক্সা চালায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রীদের নিয়ে সারা জেলায় বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করে। যা আয় হয় তা দিয়ে তার সংসার চলে সুন্দরভাবে। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও চলে। সে এখন স¦প্ন দেখে সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে। তার আশা পুরুষশাসিত এ সমাজে কুড়িগ্রামের মতো প্রত্যন্ত জেলায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ পেশায় এগিয়ে আসুক। এক সময় পুরুষরা তাকে যৌন হয়রানি করলেও কোন প্রতিবাদ করেনি। নীরবে মেনে নিয়েছিল সব কিছু। এখন পুরুষ অটো চালকরাই তাকে সাহায্য করে। শুরুর দিকে দু-তিন মাস নারী বলে তার অটোরিক্সাতে কোন যাত্রী উঠতে না চাইলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব বাধাও সে কাটিয়ে উঠেছে। কুড়িগ্রাম শহর থেকে রংপুর দীর্ঘ ৬০ কিমি যাত্রী নিয়ে অনায়াসে চলাচল করে। কোথাও কোন সমস্যা হয় না স্বপ্না রানীর। নাগেশ^রী উপজেলার ভিতরবন্ধ ইউনিয়নের ডিগডারী ভবানীপুর গ্রামে স্বপ্না রানীর বাড়ি। এক যুগ আগে পার্শ^বর্তী ফুলবাড়ী উপজেলার ভাঙ্গামোর ইউনিয়নের পাখিরহাট গ্রামে স্বামী রতন রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে তার দু’ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়। কিন্তু অভাব অনটনের সংসারে স্বামী রতন তাকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করত। স্ত্রী সন্তানদের রেখে ১০ বছর আগে স্বামী পালিয়ে যায়। সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়ে স্বপ্না রানী। বাধ্য হয়ে কখনও মানুষের বাড়ীতে ঝিয়ের কাজ কখনও মাটিকাটার কাজ করে জীবন চালিয়েছে। ২০১৬ সালে গ্রামে স্বপ্ন প্রজেক্টে ৩৫ নারীর সঙ্গে দেড়শ’ টাকার মজুরিতে মাটি কাটার কাজ শুরু করে স্বপ্না রানী। মাটি কাটার কাজের এক পর্যায়ে নাগেশ^রী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নারীদের উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের অটোরিক্সা কিনে দেয়ার প্রস্তাব দেন। কেউ রাজি না হলেও স্বপ্না রানী সে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ৭৫ হাজার টাকা উপজেলা প্রশাসন আর ৭৫ হাজার টাকা নিজে মোট এক লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে অটো রিক্সা কিনে দেন ঐ কর্মকর্তা। জীবনের নতুন মোড় ঘোরা শুরু হয় তার। অটোরিক্সা নিয়ে স্বপ্না রানী গ্রামের বাড়ি চলে আসে। প্রতিবেশী দুলাভাই জমশের আলীর কাছে টানা ছয়দিন অটো চালানো শিখে ফেলে। বৃদ্ধা মা সাবেত্রীর অনুমতি নিয়ে একদিন রাস্তায় অটোরিক্সা নিয়ে বের হয়। গ্রামবাসী তার অটো চালানো দেখে অবাক দৃষ্টিতে দেখে। আর মোল্লারা নানা কথা বলে। স্বপ্নারানী জানায় প্রথম দিকে পুরুষরা তার অটোতে চড়তে চাইতো না। কারণ কোথাও যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। সে জানায় প্রতিদিন সব খরচ বাদ দিয়ে তার গড় আয় ৭শ থেকে এক হাজার টাকা। সংসারের খরচ, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ আর কিস্তির টাকা পরিশোধ করে কোন টাকা জমাতে পারে না। এনজিও এর কাছে লোন নিয়ে অটোরিক্সা কেনার টাকা দিয়েছিল। এটা শোধ করতেই দুই বছরের বেশি সময় লেগে যাবে। সে আরও জানায় সব সময় একটা অটোরিক্সা নিয়ে আতংকে থাকি। আর একটা অটোরিক্সা যদি কিনতে পারতাম তাহলে তাদের গ্রামের দু একজন মেয়েকে এ পেশায় নিয়ে আসতাম। তার আয়ও হতো। সারাদিন অটো চালালেও রাতে বাড়িতে সন্তানদের সঙ্গেই থাকে। তাদের পড়াশুনার খোঁজ নেয়। তাদের উচ্চশিক্ষিত করে তোলাই তার এখন স্বপ্ন।
×