ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এখন বিশ্ববাজারে

প্রকাশিত: ২৩:২২, ২০ জুন ২০১৭

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এখন বিশ্ববাজারে

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ বিশ্বের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি নারীর শাড়ির প্রতি রয়েছে আলাদা টান। তাই তাঁত শাড়ির প্রতি তাদের বাড়তি আকর্ষণ আবহমানকালের। টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি বাঙালি নারীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। প্রতি বছরের মতো এবারের ঈদেও টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র আর নতুনত্ব। বাহারি ডিজাইনের শাড়ি বুনন এবং দেশ-বিদেশে সরবরাহে এখন ব্যস্ত সময় কাটছে টাঙ্গাইলের তাঁতী পল্লীগুলো। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ির। এবার শুধুমাত্র ভারতেই রপ্তানি হয়েছে প্রায় ২০ লাখ পিস শাড়ি। শাড়ির পাশাপাশি থ্রি-পিসের চাহিদাও ব্যাপক রয়েছে। অন্যান্যবারের চেয়ে এবার আরও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা কাজ করে যাচ্ছেন। ঈদ সামনে রেখে প্রায় ৩০ লাখ পিস অতিরিক্ত শাড়ি উৎপাদন করা হয়েছে। এ থেকে প্রায় একশ’ কোটি টাকার ওপরে ব্যবসা হবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের। তবে বরাবরের মতো এবার কিছুটা বাড়তি দামে পছন্দের শাড়ি কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবং ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করা গেলে এবার ঈদে ভাল ব্যবসা হবে বলে আশা তাদের। তাই ঈদ সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় মুখরিত এখন টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীগুলো। চলছে কাপড় বুননের ধুম। বেশি দাম দিয়ে সুতা কেনা হলেও কাপড় বুনন কাজে দিন-রাত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তাঁতীরা। জেলার পাথরাইল, চন্ডি, বাজিতপুর, নলসন্ধ্যা, নলুয়া, বড়টিয়া, চিনাখোলা, মঙ্গলহোড়, টেগুড়ি, বীরপুষিয়া, গোপালপুর, রূপসী, ডুলুটিয়া, ছিলিমপুর, দেলদুয়ার, পোড়াবাড়ী, চাড়াবাড়ী, এনায়েতপুর, করটিয়া, কালিহাতী, বল্লা, রামপুর, মমিননগর, কোকডহরা, নাগবাড়ি, কাজীবাড়িসহ তাঁতপল্লী এলাকাগুলোতে প্রবেশ করলেই শোনা যায় তাঁতের খটখট শব্দ। দিন-রাত চলছে কাপড় বুননের প্রতিযোগিতা। এক পরিসংখ্যানে জেলায় ৬৪ হাজার একশ’ তাঁত রয়েছে বলে জানা গেছে। আর এতে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এদিকে ঈদ উপলক্ষে শাড়ি কেনার জন্য টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী ছাড়াও বিভিন্ন মার্কেটগুলোতেও ভিড় করছেন ক্রেতারা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব শাড়ি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টাঙ্গাইলের শাড়ি যাচ্ছে। আসন্ন ঈদুল ফিতরে শুধুমাত্র ভারতের বাজারেই গেছে প্রায় ২০ লাখ পিস টাঙ্গাইল শাড়ি। ঈদকে সামনে রেখে ভিন্ন ডিজাইন আর ভিন্ন দামের শাড়ি এবার বাজারে এসেছে। এরমধ্যে বালুচুড়ি, হ্যান্ডি ব্লক, জুট কাতান, সুতি, হাফ সিল্ক, জামদানি সিল্ক, মসলিন এমব্রয়ডারি, জামদানি, ধুপিয়ান, তুন্দন, ঝলক কাতান ও স্বর্ণ কাতান। এবারের ঈদে নতুন মোড়কে বাজারে এসেছে জুট কাতান। আর ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে জামদানি, সুতি, টাঙ্গাইল শাড়িসহ হাতে বোনা সিল্ক শাড়ি। ক্রেতারা এবার গরমের কারণে সুতি শাড়িকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এবারের ঈদ বাজারে প্রতি সুতি শাড়ির দাম রাখা হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ থেকে আড়াই হাজার টাকা, হ্যান্ড ব্লক ৭শ’থেকে চার হাজার টাকা, বালুচুড়ি দেড় হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার এবং জামদানি ২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া ডিজাইন ও রকম ভেদে শাড়িগুলোর দাম রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৮শ’ থেকে সাড়ে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। এন্ডি সিল্কের ওপর স্ট্রাইপ ও নক্সা করা নতুন ডিজাইনের শাড়ি ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, ধুপিয়ান ও বলাকা সিল্কের শাড়িগুলো সাড়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এবারের ঈদেও জামদানি শাড়ি তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ির মধ্যে সুতি জামদানি, বালুচুড়ি, সফ্ট সিল্ক ও বেনারসী জামদানি শাড়ির সবচেয়ে বেশি কদর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতীরাই হচ্ছে টাঙ্গাইলের আদি তাঁতী অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। শুরুতে এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ হয়ে চলে আসেন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। আবহাওয়া অনেকাংশে প্রতিকূল দেখে বসাকরা দু’দলে ভাগ হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে এদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যায়। তবে আরো ভালো জায়গায় খোঁজ করতে অনেক বসাক টাঙ্গাইলে এসে বসতি স্থাপন করেন। এখানকার আবহাওয়া তাদের জন্য অনকূল হওয়াতে পুরোদমে তাঁত বোনার কাজে লেগে পড়েন। টাঙ্গাইলে বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ তারা তাঁত বুনে আসছেন। এককালে টাঙ্গাইলে বেশির ভাগ এলাকা জুড়ে বসাক শ্রেণির বসবাস ছিল, তারা বসাক সমিতির মাধ্যমে অনভিজ্ঞ তাঁতিদেরকে প্রশিক্ষণ দান ও কাপড়ের মান নিয়ন্ত্রন করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ ও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনেক বসাক তাঁতী ভারত চলে যান। এ সময় বসাক ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁত শিল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। তারা বসাক তাঁতীদের মতোই দক্ষ হয়ে উঠেন। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে, গভীর মনোসংযোগের সাথে অত্যন্ত সুক্ষè ও সুদৃশ্যভাবে। পুরুষেরা তাঁত বুনে, আর চরকায় নারীরা সুতা কাটে। রঙকরা, জরির কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির মহিলারা। তাঁতীরা মনের রঙ মিশিয়ে শাড়ির জমিনে শিল্প সম্মতভাবে নানা ডিজাইন করে বা নকশা আঁকে, ফুল তোলে। জেলার তাঁতপল্লীগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন তাঁতপল্লী এলাকা সরগরম হয়ে উঠেছে। তাদের তৈরি কাপড় ব্যাপকভাবে দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। হরেক রকম ডিজাইনের নিজেদের পছন্দের কাপড় কিনতে মার্কেটে ক্রেতা ও পাইকারদের কমতি নেই। উৎপাদন বেশি ও অন্যান্য মাসের চেয়ে একটু বেশি লাভবান হতে তাঁত মালিকরা বোনাস নিয়ে হাজির হচ্ছেন শ্রমিকদের সামনে। আর শ্রমিকরাও বোনাসের আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁতপল্লীগুলোতে শুধু পুরুষ নয়, বাড়ির মহিলারাও যথেষ্ট শ্রম দিচ্ছে। কেউ সুতা ছিটায় উঠানোর কাজে, কেউ সুতা পাড়ি করার কাজে, আবার কেউ সুতা নাটাইয়ে উঠানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। শেষ মুহুর্তে তাঁতী এলাকাগুলোতে চলছে কাপড় তৈরির ধুম। টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানীখ্যাত পাথরাইলের যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং-এর স্বত্ত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক বলেন, দেশের দূরদূরান্ত থেকে আমাদের নিয়মিত ক্রেতারা আসছেন। পাশাপাশি নতুন ব্যবসায়ী ও বিদেশিরাও আসছেন, সরাসরি টাঙ্গাইল শাড়ি নিতে। এবার শাড়ির মূল্য অন্য বছরের তুলনায় স্বাভাবিক। আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের আয়ের কথা চিন্তা করে যতটা সম্ভব মূল্য কম রাখার চেষ্টা করছি। আমরা শ্রম-ঘাম ঝড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ঈদের বাজারে অতীতের মতোই টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি তার নিজস্ব স্বকীয়তায় ক্রেতাদের মন জয় করবে।
×