ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তৃপ্তি বালা

স্মরণ ॥ গৌর চন্দ্র বালা

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৯ জুন ২০১৭

স্মরণ ॥ গৌর চন্দ্র বালা

গতকাল ছিল বাবার তিরোধান দিবস। ২০০৫ এ এই দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর স্মৃতি মনের মধ্যে বড় একটা জায়গা জুড়ে আছে। ছেলেবেলায় তাঁর সঙ্গে প্রাণীকুলের ঐরাবত আর বৃক্ষকুলের মধ্যে বটবৃক্ষের সাদৃশ্য পেতাম আমি। কেমন একখানা নির্ভার আস্থার জায়গা তিনি আমার। সেই মানুষটি হঠাৎই যখন ইহলোক ত্যাগ করে গেলেন, মাথার ওপর থেকে যেন ছায়াটি সরে গেল। হতবুদ্ধির এক ভগ্ন অবস্থা মনের তখন। মানুষকে যে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়, বাবা-মা চিরদিন থাকে না কারও- এই সত্যটি যেন ভুলেই ছিলাম। তবে তাঁর এই প্রস্থান হঠাৎই আমাদের কিছু উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। জীবন থাকতে যে সব কথা, যে সব বিষয় একজন মানুষ সম্পর্কে আমরা ভুলে থাকি- সে সব কথা, সেই সব বিষয় একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং জীবৎকালের ভুলে থাকা বিস্মৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠককে দীর্ঘ কত বছর পরে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় প্রশাসন। ফরিদপুর অম্বিকা হলে শহীদ মিনার পাদদেশে তাঁর সৌম্য নিথর দেহটিকে ফুল দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার জানানো হয়েছিল। বিউগ্লের সুরে-সুরে মনের সমস্ত আবেগ ফুলে-ফেঁপে উঠছিল- যেন কত কালের পথ পেরিয়ে তিনি আবার বেঁচে উঠলেন! জীবদ্দশায় যা আমরা ভুলে ছিলাম, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাই আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। আমার বাবা, শ্রী গৌর চন্দ্র বালা এই দেশ এবং জাতির এক গৌরবময় সময়ের অংশ। তাই তো এই স্মরণ, এই শ্রদ্ধা নিবেদন এক সর্বজনীন বিষয়েরই অংশ। তিনি কেবল মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকই যে ছিলেন তা নয়, বরং বলা চলে সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি সে দায়িত্বটুকু পালনের অনিবার্য অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। ’৪৭ পরবর্তী দেশ ভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব- বিকাশের কালে জন্মভূমিতে চলে আসেন তিনি। পূর্ব বাংলায় ঘটেচলা রাজনৈতিক টালমাটাল সেই সময়ে মুসলিম লীগের মন্ত্রী এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কার্যকলাপে তখন ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। বাঙালী সাধারণের পক্ষে দাঁড়াতে মাদারীপুরের ঐ এলাকায় একজন শিক্ষিত বাঙালীর প্রয়োজন ছিল। কোন রকম সময় নষ্ট না করে ছোট কাকা গ্রামের দুজন স্বজনসহ গিয়ে হাজির হন, ‘তোমাকে আমাদের সঙ্গে দেশে যেতে হবে, গ্রামের মানুষের জন্যে কাজ করতে হবে!’ এক বাক্যে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্বদেশভূমিতে ফিরে আসেন তিনি। মানুষের প্রতি ভালোবাসার দরদী মনটি দিয়ে অল্পদিনেই সাধারণের একজন হয়ে ওঠেন। ১৯৫৪-এ তিনি প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫-এ গণপরিষদ সদস্য এবং ১৯৫৬-এ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিপরিষদের বন ও খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পরিচয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধন তৈরি হয়। ছয় দফা আন্দোলনে ফরিদপুরে এবং ফাতেমা জিন্নাহর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনকালে ১৯৬৪-এ দক্ষিণবঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একযোগে কাজ করেছেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরই তো মুক্তিযুদ্ধের কাল। অনিবার্য সেই যুদ্ধে তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম বেসামরিক জোন-২ এ কার্যকরী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীনের পর নতুন দেশে উদ্যম-উদ্দীপনার মহা চাঞ্চল্য, আমার তখন শৈশব। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন একটি দেশকে বিনির্মাণের যে উদ্যোগÑআয়োজন- তার এক ইউনিক মডেল ছিল আমাদের বাড়ি এবং বাবা ছিলেন তার কেন্দ্রিক শক্তি। দেখেছি রিলিফের জিনিসপত্র বাবার বৈঠকখানা থেকে বিলি হতো। আমরা দেখেছি সবুজ বিপ্লব। বাড়ির সামনে-পিছনের জায়গায় হাল চষে শাক-সবজি, ফল- এমনকি ধানের চারা পর্যন্ত লাগানো হয়েছিল। মামা-কাকা, স্বজন-বন্ধুর কর্মীবাহিনী সবে ব্যস্ত থাকতেন সে কাজে। মোটের উপর বেশ একখানা কর্মযজ্ঞই চলেছে তখন দেশটিতে। হঠাৎই একদিন সকাল বেলা আমরা দেখলাম, কারা যেন রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে গেছে ধান, আর সমস্ত ক্ষেতটা বিস্রস্ত-এলোমেলো গরু-ছাগল দিয়ে মাড়িয়ে রাখা! পাকা ধান আর ঘরে তোলা হলো না আমাদের। আহা সোনালি সে ধানের শীষ কেমন তরতর করে বেড়ে উঠেছিল! তারপর হঠাৎই একদিন খুব ভোর বেলা- বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত- শুনতে পেলাম! তার কত আগেই ঘনিষ্ঠ সহোচর দুর্দিনের, নিবেদিত মানুষজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর থেকে। তাঁর চারপাশে তখন সুবিধাবাদী কুচক্রীর দল। তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতা পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বঙ্গবন্ধু আটকে গেছেন ষড়যন্ত্রীদের ব্যুহচক্রে। গৌরবের সব অর্জন মিলিয়ে গেছে দিনে দিনে। আজ যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছি- মনে করতে পারি না- এ সেই পিতার স্বপ্নের স্বাধীন দেশ। যে উগ্র মৌলবাদ থেকে বেরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল- আজ মনে হয় তার সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। বৈষম্যহীন নৈতিক সমাজ গঠনের যে অঙ্গীকার ছিল- আজ তার সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। বাংলাদেশ আজ যেন দুর্নীতি- বৈষম্যের নিদারুণ চিত্রভূমি! অথচ সংস্কৃতির মানবিক পথে জীবন যাপন আমাদের ঐতিহ্য। মানুষ হবার যে শিক্ষা পেয়েছি তাঁর কাছে, সেই তো হয়ে আছে জীবনের পাথেয়। জন্মস্থান উল্লাবাড়ি গ্রামে (মাদারীপুরের রাজৈর থানা) ঠাকুর্দার জায়গায় বাবা দুটি বিদ্যালয় (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গ্রামের ছেলেমেয়েরা কত অনায়াসে সেখানে লেখাপড়া করতে পারছে। পিতার স্মরণে সন্তান হিসেবে তাঁর জীবন-বোধের প্রতি আরেকবার আনত হই। লেখক : চিকিৎসক, গল্পকার গৌর চন্দ্র বালার কনিষ্ঠ কন্যা
×