ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

জেরেমি করবিন ॥ তরুণদের যেভাবে আকৃষ্ট করলেন

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ১৩ জুন ২০১৭

জেরেমি করবিন ॥ তরুণদের যেভাবে আকৃষ্ট করলেন

ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা তিনি। অথচ তার নিজের একটি গাড়িও নেই! বিলাসী জীবন তো পছন্দ করেনই না, মদ্যপানও করেন না খোঁচা খোঁচা দাড়ির শুভ্রকেশী এই ভদ্রলোক। ব্রিটেনের অভিজাত রাজনীতিক শ্রেণীর কাছে তিনি অচ্ছুৎ, বেমানান। এমনকি নিজের দলের অভিজাত গোষ্ঠীও তাকে খুব একটা সইতে পারে না। কিন্তু নীতি আদর্শে অবিচল কট্টর বামপন্থী রাজনীতিবিদ নিজ দলের তৃণমূলে দারুণ জনপ্রিয়। বন্ধুরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমি কার কথা বলছি। বলছি জেরেমি করবিনের কথা । বর্তমান সময়ে আলোচিত নাম জেরেমি করবিন। সব আলো এখন তার দিকে। হেরেও জয়ী তিনি। ৮ জুন বদলে দিয়েছে তার ভাগ্য। অথচ আট সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে যখন আচমকা নির্বাচনের ঘোষণা দেন তখনও পরিস্থিতি এমন ছিল না। লেবার প্রধানের অবস্থান ছিল অনেকটাই নড়বড়ে। তাকে তুলনা করা হয়েছিল ১৯৮৩ সালের লেবার নেতা মাইকেল ফোট এবং ১৯৩৫ সালের জর্জ লেন্সবারির সঙ্গে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম জেরেমি বার্নার্ড করবিনের। উইল্টশায়ার কাউন্টির কিংটন সেন্ট মাইকেল নামে ছবির মতো এক গ্রামে ছেলেবেলা কাটে তার। চার ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ছিলেন তিনি। মা ছিলেন শিক্ষক, বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। কিন্তু দুজনেই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। বাড়িতে রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা বিতর্ক হতো। জেরেমি করবিনের বড় ভাই পিয়েরস একজন কড়া বামপন্থী। স্কুল ছাড়ার প্রায় পরপরই পোশাক শ্রমিকদের ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন জেরেমি করবিন। পরে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিকাল ইউনিয়নে এবং ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পাবলিক এমপ্লয়িজের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু তার আসল উৎসাহ ছিল লেবার পার্টি। ১৯৭৪ সালে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে উত্তর লন্ডনের হ্যারিংগে কাউন্সিলের নির্বাচিত হন তিনি। ওই একই বছর সহকর্মী নারী কাউন্সিলর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেন চ্যাপম্যানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। জেরেমি করবিন ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর পশ্চিমা গণতন্ত্রে প্রচলিত শাসন কাঠামোর বিরোধিতা নতুন প্রপঞ্চে পরিণত হয়। এ ধারার পতাকা হাতেই ব্রিটিশ রাজনীতিতে জেরেমি করবিনের বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছিল ২০১৫ সালে। ব্রিটিশ রাজনীতির প্রধানতম দল লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হন জেরেমি করবিন। প্রধান নির্বাচিত হওয়ার আগে করবিন দলের কোনও নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে বা দল গঠিত সরকারের কোনও পদে ছিলেন না। করবিনের রাজনীতির মূল বিষয় ছিল বিদেশে যুদ্ধে ব্রিটেনের জড়িয়ে পড়া এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। করবিন সবসময় বিরোধিতা করেন দলে বিত্তশালী শ্রেণীর একাধিপত্যকে। রাজনৈতিক এই দর্শন থেকে লেবার পার্টি ১৯৭০-র দশকে সরে যায়। ওই সময় ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টির কাছে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা ছাড়ে লেবার পার্টি। নির্বাচনের আগে লেবার পার্টি বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং আপাত দৃষ্টিতে একটি সমাজতান্ত্রিক ইশতেহার প্রকাশ করে। অনেকেই এটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সুইসাইড নোট হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। এরপর পর ১৯৮৩ সালের ৯ জুন আধুনিক সময়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী পরাজয়ের সম্মুখীন হয় লেবার পার্টি। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির যেসব এমপি প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন করবিন ছিলেন তাদের একজন। ওই সময় তার বয়স ছিল ৩৪ বছর। আরেক নতুন এমপি ছিলেন টনি ব্লেয়ার। করবিনের চেয়ে ব্লেয়ারের বয়স ছিল চার বছর কম। ১৯৮০ ও ১৯৯০-র দশকে টনি ব্লেয়ার ছিলেন লেবার পার্টির বাম ঘরানার নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি। পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস ও চতুর্থ ধারার পক্ষে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন লেবার পার্টির বাম অংশটি। চতুর্থ ধারাটিতে শিল্পের গণমালিকানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে দলের নেতৃত্বে আসার পর নতুন লেবার- গড়ে তোলার ঘোষণা দেন টনি ব্লেয়ার। এ সময় দলটি অপরাধ প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর ও মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে অবস্থান নেয়। লেবার পরিণত হয় বিল ক্লিনটনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মধ্যপন্থীতে। ১৯৯৭ সালে আঠারো বছরের মধ্যে প্রথমবার ক্ষমতায় আসে টনি ব্লেয়ারের লেবার পার্টি। করবিনসহ লেবার পার্টির সমাজতান্ত্রিক এমপিদের কয়েকজন তখন ক্যাম্পেন গ্রুপ বলে পরিচিত। লেবার পার্টির এই বদলে যাওয়ার বিরোধিতা করতেন। টানা ক্ষমতায় থাকা ১৩ বছরের মধ্যে ১০ বছর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন টনি ব্লেয়ার। এই সময়ে করবিন দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৪২৮বার ভোট দিয়েছেন। যা যে কোনও লেবার এমপির চেয়ে বেশি। কিন্তু পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় করবিন ও তার মিত্রদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। সবসময়ের মিষ্টভাষী করবিন ২০১৫ সালে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমি বেশি টাকা পয়সা খরচ করি না, খুব সাধারণ জীবন আমার। আমার কোন গাড়ি নেই। সাইকেলে যাতায়াত করি। আমি উচ্চশিক্ষায় যাইনি কখনও, ফলে যাদের উচ্চশিক্ষা নেই, তাদের প্রতি নিচু চোখে তাকাইনি। আবার যাদের উঁচু ডিগ্রী রয়েছে তাদের প্রতি আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকিনি। আমাদের রাস্তাগুলো যারা ঝাড়ু দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই এই সমাজের অত্যন্ত মেধাবী লোকজন।’ জেরেমি করবিন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এমপি হলেও তিনি কখনও মন্ত্রিসভা কিংবা ছায়া মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিরোধিতা, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান, সাম্যবাদী আন্দোলন ও শ্রমিক অধিকারের প্রচারে যুক্ত থাকা করবিন একজন চরম বামপন্থী নেতা বলে পরিচিত। ক্যামেরন সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির বিপরীতে অবস্থান নিয়ে যাতায়াত ও জ্বালানি খাতকে সরকারীকরণের কথা বলছেন করবিন। জেরেমি করবিন ক্রমাগত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, রেল খাতের রাষ্ট্রীয়করণ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর কথা বলে যাচ্ছেন। বহু তরুণ-তরুণী ও যুবক তার এই সব বার্তায় আকৃষ্ট হয়ে তার দলকে ভোট দেয়।
×