ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

রেমিটেন্স বনাম টাকার অবমূল্যায়ন

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ২ জুন ২০১৭

রেমিটেন্স বনাম টাকার অবমূল্যায়ন

আজকে শুক্রবারের কাগজভর্তি বাজেটের খবর। অথচ আমি লিখছি অন্য বিষয়ে। এর কারণ, আমি যখন লিখছি তখন আমি বাজেটের কিছুই জানি না। এটা প্রত্যেক বছরের ঘটনা। বাজেট ঘোষণা করা হয় বৃহস্পতিবার, আর আমার কলাম শুক্রবার। অতএব বাধ্য হয়েই লিখছি বাজেটের অন্তর্নিহিত আরেকটি বিষয়ের ওপর। বিষয়টি রেমিটেন্স, রেমিটেন্স হ্রাস। অতএব কেউ কেউ বার বার বলে যাচ্ছেন, টাকার মানে অবমূল্যায়ন দরকার। রেমিটেন্স আসছে অবৈধ পথে, যেখানে এক ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়া যায়। এ কারণেই রেমিটেন্স ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে অথচ রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির প্রাণবায়ু। তিন ভিত্তির একটি। আমাদের রফতানি আয় কম, আমদানি ব্যয় বেশি। এর ব্যবধান আশি-নব্বই হাজার কোটি টাকা। মারাত্মক ঘটনা। টাকা আসবে কোত্থেকে? আসে গরিবের ‘পোলাদের’ রেমিটেন্স থেকে। এমন গুরুত্বপূর্ণ রেমিটেন্স ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেলে অর্থনীতি কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাজেট নির্মিত হবে কীভাবে? মানুষের ভোগান্তর (কনজামশন) ঠিক থাকবে কীভাবে? নানা প্রশ্ন যা বাজেটের আলোচনাকেই ব্যর্থ করে দেয়। এমতাবস্থায় দেখা দরকার ‘অবমূল্যায়নের’ দাবিটি কেন এবং এটা যুক্তিযুক্ত কিনা? প্রথমেই প্রশ্ন রেমিটেন্স হ্রাস পাচ্ছে; কেন? সরকারের একটি প্রতিনিধি দল বিদেশ ‘ভ্রমণ’ করে এসে বলেছে ‘হুন্ডিতে’ টাকা দেশে আসছে, বিকাশের মাধ্যমে টাকা দেশে আসছে। এতে প্রাপকরা টাকা বেশি পায়। এ কারণেই রেমিটেন্স হ্রাস পাচ্ছে কিন্তু গোল বেঁধেছে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কথায়। তিনি বলেছেন, আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা দেশে টাকা কম পাঠিয়ে বিদেশেই ডলারে জমাচ্ছেন। এর সঙ্গে অনেকেই বলছেন, বিদেশে অনেক বাংলাদেশী নতুন নতুন ব্যবসায় নামছেন তাদের রোজগারের টাকা দিয়ে। আমি এমন একজন মেকানিকের কথা জানি যার দুই ভাই বিদেশে থাকে। তারা সেখানে ওয়ার্কশপ খুলেছে জমানো টাকা দিয়ে। এই হচ্ছে এক দিক। গত সপ্তাহে দুজন ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের একজনের ভাই ওমানে থাকে, আরেকজনের ভাই ইতালিতে। দুজনই বলেছে, ভাইদের রোজগারে ভাটা পড়েছে। তারা তাই টাকা পাঠাচ্ছে কম। এর জন্য তাদের পরিবার বেশ কষ্টে আছে। একজনের পরিবারের সাতজন ‘খানেওয়ালা’ রোজগারি মাত্র একজন যে একটা টিভি চ্যানেলের ড্রাইভার। এসবের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরেরও সামঞ্জস্য আছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ সর্বত্র চাকরির বাজার মন্দা। অতএব বিশ্বজুড়েই রেমিটেন্সে মন্দা। কয়েক দিন আগে কাগজে দেখলাম পাকিস্তান ও ভারতেও রেমিটেন্সে টান পড়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে ‘হুন্ডিকে’ দায়ী করে টাকার অবমূল্যায়নের দাবি তোলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? এ ছাড়া আরও একটা কথা আছে। প্রশ্ন, ‘হুন্ডি’ কবে ছিল না? হুন্ডিতে রেমিটেন্সের টাকা দেশে আনা, হুন্ডিতে দেশ থেকে টাকা বাইরে নেয়ার ব্যাপারটি আদ্যিকালীন বিষয়। এটা সব সময়ের ঘটনা। কখনও বাড়ে, কখনও কমে। এমতাবস্থায় আমাদের দরকার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা। রেমিটেন্স কমে গেলেই ‘হুন্ডিকে’ দোষারোপ করা, আবার কিছুটা বাড়লেই চুপ থাকা কোন বিবেচনাপ্রসূত কা- নয়। এ কথা বলছি কারণ, ‘হুন্ডি’ আদি ও অকৃত্রিম। যতদিন সরকারীভাবে অর্থনৈতিক লেনদেনে অসামঞ্জস্য থাকবে ততদিন ‘হুন্ডি’ থাকবে। এটা খুবই সংগঠিত ও দক্ষ একটা ব্যবস্থা যা প্রতিযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই প্রেক্ষাপটে ‘ডিভ্যালুয়েশন’ বা অবমূল্যায়নের বিষয়টিকে অন্যদিক থেকে বিবেচনা করা যায়। যেমন বলা হচ্ছে ‘হুন্ডিতে’ রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে দুই-চার টাকা প্রতি ডলারে বেশি পাওয়া যায়। যদি একে সত্য ধরে নিই তাহলে প্রাপকদের তাতে বেশ লাভ। নিশ্চয়ই লাভ। কিন্তু ডলারের দাম বাড়ানো হলে নিশ্চিতভাবেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। কারণ আমরা আমদানিনির্ভর একটা দেশ। তেল থেকে শুরু পেঁয়াজ-রসুনও আমদানি করতে হয়। অর্থাৎ টাকার ‘অবমূল্যায়ন’ ঘটানো হলে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। যদি তাই হয় তাহলে রেমিটেন্স প্রাপকরা যে বেশতি টাকা পাবে ‘অবমূল্যায়ন’ করা হলে সেই টাকা তো জিনিসপত্রের বেশতি মূল্য পরিশোধেই চলে যাবে। তাই নয় কী? যদি তাই হয় তাহলে অর্থনীতির কী লাভ হলো? এ ছাড়া রয়েছে আরও অনেক প্রশ্ন। টাকার দাম ডলারের বিপরীতে কত হবে, এক ডলার কী ৮০ টাকায় পাওয়া যাবে, না ৮২/৮৫ টাকায় পাওয়া যাবে তার প্রভাব আমদানি ও রফতানি উভয় ক্ষেত্রেই পড়বে। রফতানিকারকরা দৃশ্যত লাভবান হবেন বলে সবাই দাবি করেন। কিন্তু তারাও রফতানির জন্য মাল আমদানিও করেন। তুলা, সুতা, রং, বক্রম , বোতাম থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তাদের প্রতিনিয়ত আমদানি করতে হয়। এসবের ওপর তো তাদের বেশি টাকা আমদানি বাবদ খরচ হবে। তাই নয় কী? আখেরে তাদের তাহলে কী লাভ হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন রফতানিকারক ছাড়াও দেশে রয়েছে বিপুলসংখ্যক আমদানিকারক। তারা আমদানি করে দুই কারণে। শিল্পের কাঁচামাল আনে তারা, মধ্যবর্তী পণ্য আনে তারা, যন্ত্রপাতি আনে তারা। তারা প্রতিদিন বলছেন প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারছেন না। চীনা মালে বাজার সয়লাব। দাম কম। এমতাবস্থায় যদি আরও বেশি টাকা দরে ডলার কিনে মাল আমদানি করতে হয় তাহলে তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পাবেÑ এটা তো পাগলেও বোঝে। অর্থাৎ আমি যা বলছি তা হচ্ছে টাকার মূল্যমানের সঙ্গে শুধু রফতানি বৃদ্ধির সম্পর্ক নয়, আমদানি খরচ বৃদ্ধিরও সম্পর্ক। এখানেই লুক্কায়িত আরেকটি পক্ষ। আর সেই পক্ষ হচ্ছে ‘জনগণ’ আমজনসাধারণ। তারা আবার টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত? ভীষণভাবে। কারণ শেষ বিচারে তাদেরই এর বোঝা বহন করতে হবে। কীভাবে? আগেই বলেছি চাল, ডাল, গম, নুন, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা থেকে শুরু করে আমাদের সব ভোগ্যপণ্যই আমদানি করতে হয়। এমন নয় যে, শুধু শিল্পপণ্য ও কাঁচামাল আমরা আমদানি করি। যেহেতু সব ভোগ্যপণ্যই আমাদের আমদানি করতে হয় অতএব ডলারের দাম বাড়লে বা টাকার অবমূল্যায়ন হলে সকল ভোগ্যপণ্যের দামই বাজারে বেড়ে যাবে। এতে ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে। মূল্যস্ফীতি ঘটবে, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এর ‘নতিজা’ কী? ‘কনজামশন’ স্তর নিচে নামবে। নিচে নামলে প্রাক্কলিত ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হবে কীভাবে? তাতেও কোন আপত্তি ছিল না যদি মানুষের আয় বাড়ত, মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ত। সরকারী তথ্যেই কয়েকদিন পর পর ‘বিবিএস (বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস) বলছে, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না। আগে যে হারে বাড়ত, সেই হারে ঘাটতি পড়ছে। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু তা হচ্ছে ‘জবলেস গ্রোথ’। জানি না এসব তথ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হচ্ছে কিনা। আমি নিশ্চিত এসব তথ্য তাকে জানালে তিনি উদ্বিগ্ন হবেন এবং ‘ইন্টারভিন’ করবেন। তাকে কী গার্মেন্টস মালিকরা বলছেন যে, গার্মেন্টস খাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। সবই এখন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে করার ব্যবস্থা হচ্ছে। যন্ত্র এখন শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করছে। বেসরকারী খাতে লোকের চাকরি যাচ্ছে হরদম। এই চিত্র সব ক্ষেত্রে। এর অর্থ কর্মসংস্থানে গতি শ্লথ। অন্যদিকে প্রকৃত মজুরি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এসব কথা কেন বলছি? বলছি কার্যত যদি আয় বাড়ত তাহলে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য মানুষের বেশি দামে কিনতেও অসুবিধা হতো না। শত হোক রোজগার বাড়লে, বেতন বাড়লে বেশি দামে জিনিসপত্র কিনতে কী অসুবিধা? কোন অসুবিধা নেই। অথচ দেখা যাচ্ছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছেই আর বিপরীতে মানুষের আয় কমছে। ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন আর কোন সুদ পাওয়া যায় না। সাড়ে পাঁচ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতির হার অথচ ব্যাংকের সুদের হার পাঁচ শতাংশেরও কম। নানা রকম কর কেটে নেয়া হয়। অগ্রিম আয়কর পর্যন্ত। এমন ঘটনা, যে ব্যক্তি কোন দিন আয়করের মধ্যে পড়বে না তার কাছ থেকেও আয়কর কেটে নেয়া হয়। আজ থেকে ৮-৯ বছর আগেও ব্যাংক সুদের হার ছিল ১২-১৩ শতাংশ, এখন তা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। শোনা যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের ওপর আবার কাঁচি চালানো হবে। যারা চালাবেন তাদের অধিকাংশই সরকার থেকে ৫-১০ কাঠা জমি ভর্তুকিতে পেয়েছেন। প্রত্যেকে এতে লাভবান এক-দুই-তিন কোটি টাকার। এক টাকার জমি পাঁচ পয়সায় পেয়েছেন। শোনা যাচ্ছে তারাই লাখ লাখ লোকের সঞ্চয়পত্রে দুই আনা, চার আনার লাভ কমাতে ‘দা’ নিয়ে হাজির হচ্ছেন। যদি তা ঘটে তাহলে মধ্যবিত্তের আয় আর কমবে। তাই নয় কী? এত কথা বলার কারণ একটিইÑ আর তা হচ্ছে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটালে সাধারণ মানুষের ক্ষতির কোন সীমা থাকবে না, ভোগান্তির কোন সীমা থাকবে না। মোটকথা ইংরেজীতে যাকে বলে ‘ডিভ্যালুয়েশন’ তার পক্ষ শুধু রেমিটেন্স প্রাপকরা নন। এর পক্ষ অনেক যথা : রেমিটেন্স প্রাপক, রফতানিকারক, আমদানিকারক এবং সর্বোপরি জনগণ। আপসোসের কথা, আমরা যখন কথা বলি তখন একটা পক্ষে কথা বলি। অন্য পক্ষকে চোখে দেখি না। ওটা তো ঠিক নয়। আরও মারাত্মক বিষয় হচ্ছে যারা একপাক্ষিক কথা বলেন তাদের বেশিরভাগই সরকারের অনুগ্রহভোগী। তারা সরকারের কাছ থেকে বহু ভর্তুকি নানাভাবে পান। অথচ সাধারণ মানুষ সেই সুযোগ পান না, পান না মধ্যবিত্তরা, সঞ্চয়কারীরা, নারীরা, মুক্তিযোদ্ধারা। সরকারের কাছ থেকে যারা কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি হাজার টাকায় নিয়েছেন তারা কী করে ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদ কমলে চুপ থাকেন, কী করে তারা সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর উদ্যোগে চুপ থাকেন তা আমার বোধগম্য নয়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×