ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেরপুরে সাদা ভুট্টার চাষ

কম খরচে উৎপাদন রফতানিযোগ্য, চাপ কমবে চাল গমে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১ মে ২০১৭

কম খরচে উৎপাদন রফতানিযোগ্য, চাপ কমবে চাল গমে

রফিকুল ইসলাম আধার ॥ এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, কৃষিপ্রধান এই দেশে খাদ্যাভ্যাসে চাল ও গমের প্রাধান্যই বেশি। তবে যে হারে দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে তুলনায় চাল ও গমের মাধ্যমে খাদ্য চাহিদা মেটাতে ভবিষ্যতে হিমশিম খেতে পারে দেশের সরকার। বিষয়টি মাথায় রেখেই এবার চাল ও গমের ওপর চাপ কমাতে সাদা ভুট্টা চাষে গুরুত্ব দিচ্ছে খাদ্য বিভাগ। সাদা ভুট্টা খেতে সুস্বাদু ও প্রোটিনসমৃদ্ধ। তাছাড়া আটা ও হলুদ ভুট্টার চেয়ে সাদা ভুট্টার দানা মিহি হওয়ায় পৃথিবীর বহু দেশে সাদা ভুট্টা অন্যতম সুষম খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এ ভুট্টা থেকে ৩০-৩৫ প্রকারের খাদ্যদ্রব্য উদ্ভাবন করা হয়েছে। খাবারের গুণগত মান, কম খরচে উৎপাদন ও রফতানিযোগ্য হওয়ায় কৃষি বিভাগের তদারকিতে কৃষি ও খাদ্যসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরের নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা, চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী ইউনিয়নের চাষিরা সাদা ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এ ভুট্টা চাষে অধিক লাভ দেখে অন্যসব ইউনিয়নের কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন। অনুর্বর জমি, মাত্র একটি সেচ, কম পুঁজিতে স্বল্পশ্রমে ও সরকারী সহযোগিতা পাওয়ায় উপজেলায় দিন দিন ভুট্টা চাষির সংখ্যা ও অনাবাদি জমিতে ভুট্টা আবাদের পরিমাণ বেড়েই চলছে। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই নকলা উপজেলায় বিভিন্ন দেশীয় জাতের অল্প পরিমাণে ভুট্টা চাষ করা হতো যার রং ছিল হলুদ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এবার উপজেলায় ২ হাজার ৫০ একর (৮২০ হেক্টর) জমিতে পাইওনিয়ার, এনকে-৪০, সুপার সাইন ও প্যাসিফিক জাতের ভুট্টার আবাদ করা হয়েছে, যার অধিকাংশই সাদা জাতের। তার মধ্যে রাজস্ব খাতের ৫৬টি ও পুষ্টি প্রকল্পের ৩টি প্রদর্শনী প্লট রয়েছে। প্রতি একর জমিতে ১০০ থেকে ১২০ মণ ভুট্টা উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষকরা। তাতে উপজেলায় প্রায় ৯ হাজার মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। আশানুরূপ ফলন ও ভাল দাম পাওয়ায় আগামীতে চাষীর সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। কাজাইকাটা গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলী নেওয়াজ, হুজুরিকান্দার রুবেল, কালাম, হালিম, রেজাউল, নারায়ন খোলার কিষানী তাসলিমা, বানেশ্বরদীর দেলোয়ার, ভূরদী খন্দকারপাড়া কৃষি পণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার সদস্য হেলাল, বেলাল, মোশারফ, ঈসমাইল, তাহমিনাসহ অনেক চাষী বলেন, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে উপজেলার অনেক অনুর্বর ও অনাবাদি ৭০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তাদের মতে, অনুর্বর ও অনাবাদি জমিতে ভুট্টা চাষ করলে একদিকে যেমন জমির সুষ্ঠু ব্যবহার হবে, অন্যদিকে আসবে পুষ্টি ও টাকা। কৃষক মোহাম্মদ আলী নেওয়াজ জানান, তিনি এ বছর ২ একর জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছেন। এতে প্রতি কেজি ৫১০ টাকা দামের ১১ কেজি ভুট্টা বীজ লেগেছে। তাছাড়া হুজুরিকান্দার রুবেল, কালাম, হালিম, রেজাউল, নারায়ন খোলার কিষানী তাসলিমাসহ অনেকেই জানান, যেসব জমিতে অন্য কোন শস্য আবাদ করা যায় না, সেসব জমিতে বুট্টা খুব ভাল হয়। তাই তারা এ বছর ভুট্টার আবাদ বেশি করেছেন। বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতি একরে ৩১ হাজার থেকে ৩৩ হাজার টাকা করে তাদের খরচ হবে। খরচ বাদে দ্বিগুণ লাভ হবে বলে তারা জানান। পাইকার ও রাখি ব্যবসায়ীরা বলেন, অন্যান্য শস্য কিনে রেখে দিলে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ভুট্টাতে তাদের লোকসান গুনতে হয় না। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, ভুট্টা অধিক লাভজনক ফসল হওয়ায় কৃষকরা অলাভজনক অন্য আবাদ ছেড়ে দিন দিন ভুট্টার দিকে ঝুঁকছেন। কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সকল প্রকার সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। আর ভুট্টা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে এ বছর উপজেলার ৮০ জন চাষীকে প্রণোদনা দেয়াসহ ভর্তুকি মূল্যে ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র ও বপনের জন্য বেড প্লেন্টার মেশিন বিতরণ করেছে কৃষি বিভাগ। একই কথা জানান খামারবাড়ির উপ-পরিচালক মোঃ আশরাফ উদ্দিন। এদিকে সম্প্রতি উপজেলার জালালপুর এলাকায় অনুষ্ঠিত ভুট্টা উৎপাদন কলাকৌশলের ওপর এক মাঠ দিবসে উপস্থিত হয়ে ভুট্টা গবেষক ড. আলীম উজ্জামান ও ড. শামসুর রহমান বলেন, এ দেশে চেলি, এ-ক্রস, আলাজুয়েলা, পোজারিকা, সাভার-১, বর্ণালী, শুভ্রা, সোয়ান-২, খই ভুট্টা, সিমীট কম্পোজিট ও সাদাফসহ দেশীয় জাতের ভুট্টা বেশি চাষ হলেও সাদা জাতের ভুট্টা অধিক ফলনশীল ও পুষ্টি সমৃদ্ধ হওয়ায় কৃষকরা এ ভুট্টা চাষে আগ্রহী বেশি। তাছাড়া, বিএআরআই গাজীপুরের গবেষণা বিভাগের পরিচালক ড. মোঃ লুৎফর রহমান ও আরএআরএস জামালপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. আবদুল মালেক জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বারি উদ্ভাবিত হাইব্রিড সাদা ভুট্টার চাষ ছড়িয়ে দিতে সারা দেশের মতো বারির গবেষণা বিভাগ শেরপুর অঞ্চল, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের গম ও ভুট্টার উন্নততর বীজ উৎপাদন এবং উন্নয়ন প্রকল্প-২য় পর্যায় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ড. শহিদুজ্জামান বলেন, ধান ও গম সি-থ্রি প্রজাতির শস্য, কিন্তু ভুট্টা সি-ফোর প্রজাতির হওয়ায় ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। যেখানে প্রতি হেক্টরে গম ৩ থেকে ৪ টন, ধান ৫ থেকে ৬ টন উৎপাদন হয়, সেখানে ভুট্টা উৎপাদন হয় ৮ থেকে ১০ টন। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এ দেশে বর্তমানে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে ২২ লাখ টন অধিক ক্যারোটিন সমৃদ্ধ তথা কম স্বাদযুক্ত হলুদ ভুট্টা উৎপাদিত হয়। যার অধিকাংশ মুরগি, মাছ ও গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে সাদা ভুট্টার স্বাদ চাল ও গমের মাঝামাঝি হওয়ায় ভাত ও আটার পরিবর্তে সাদা ভুট্টার দিকে ঝুঁকছেন অনেক দেশের মানুষ। তাই হলুদ ভুট্টার পরিবর্তে সাদা ভুট্টার চাষ বাড়ালে চাল ও গমের ওপর চাপ কমবে। কোন একসময় এটি হতে পারে এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল; এমন মতামতও দিচ্ছেন পুষ্টি বিজ্ঞানী ও ভুট্টা গবেষকরা।
×