ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কারাগারের রোজনামচা প্রকাশনা উৎসবে শেখ হাসিনা

হাসু, আমি মারা যাওয়ার পর এসব পড়িস

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৯ মার্চ ২০১৭

হাসু, আমি মারা যাওয়ার পর এসব পড়িস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘১৯৬৮ সালে গ্রেফতারের দীর্ঘদিন পর মুক্তি পেয়ে আব্বা (বঙ্গবন্ধু) বাসায় ফিরে আসলেন। আব্বার বালিশের তলে একটি হাতে লেখা খাতা দেখতে পেলাম। সেটি নিয়ে যেই পড়তে শুরু করেছি, তখনই আব্বা আমার কাছে আসলেন। বকা-ঝকা কিছুই করলেন না। শুধু আমার হাত থেকে তাঁর কারাগারে থাকতে লেখা খাতাটি নিয়ে নিলেন। বললেন, হাসু এখন এটি পড়লে কষ্ট পাবি। তাই এখন না, আমি মারা যাওয়ার পর এসব পড়িস..।’ বাকিটুকু আর শেষ করতে পারলেন না। বাকরুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তখন পিনপতন নীরবতা পুরো মিলনায়তনে। সেখানে উপস্থিত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সকল শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনরাও যেন নিজেদের অশ্রু সামাল দিতে পারলেন না। সবারই চোখে জল। পুরো মিলনায়তনে এক অন্যরকম পরিবেশ। মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ কারাজীবনে থাকার সময় তার লেখা নিয়ে রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন নিজে কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন সবাইকে। আবেগতাড়িত হলেও প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে বারংবার উঠে এসেছে দৃঢ় প্রত্যয় ও ঘোষণা। আর তা হলো- বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণ। রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ একাডেমি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ কারাগারের রোজনামচা গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রকাশ করা হলেও মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আলোচকদের নিয়ে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারাগারে থাকার সময় বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা নিয়ে রচিত এই বইটির নামকরণ করেছেন তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রকাশনা উৎসবে স্বাগত বক্তব্যে রাখেন বাংলা একেডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থটির কিছু অংশ পাঠ করেন সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। গ্রন্থটির ওপর আলোচনায় অংশ নেন দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে সৈয়দ রফিকুল ইসলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণা করে একটি বস্তুনিষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ জীবন রচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান। মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাধারণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও তিনি কোন বক্তব্য রাখেননি। প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসামান্য দুটি বই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা প্রকাশ করার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কয়েকবারই আবেগে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রাম করে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা, একটি ঠিকানা এবং আত্মপরিচয় দিয়ে গেছেন। কিন্তু দেশকে গড়ে তুলতে তাঁকে সময় দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয় রক্ষার দায়িত্ব এখন দেশবাসীর। বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে অসম্ভব ভালবাসতেন, একটি মানুষ দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রশ্নে কত বড় ত্যাগ করতে পারেন- তা এই দুটি বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় তা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আরও অনেক আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু তিনি সেই সময় পাননি, অনেকে তাঁকে সেই সময়টুকুও দিতে চাননি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকে কত সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা করে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির হাতকেই যেন শক্তিশালী করা হলো। ১৫ আগস্ট ঘটানোর পটভূমি তৈরি করে গেছেন। ১৫ আগস্টের পর ওই সমালোচনাকারীরা হয়ত উপলব্ধি করতে পেরেছেন তারা কী হারিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা এসব দুর্লভ পা-ুলিপি সংগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি নিয়ে কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে আমার মায়ের (ফজিলাতুন্নেসা মুজিব) কথা মনে পড়ে। অজীবন বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন, অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন। নিজের জীবনের জন্য কোন সময়ই কিছু চাননি। তাই বঙ্গবন্ধু যখনই গ্রেফতার হতেন তখনই আমার মা তাঁর হাতে খাতা ধরিয়ে দিতেন, লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো যতœ করে ধানম-ির বাসায় রেখে দিতেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৬ বছর পর দেশে ফিরতে পেরেছি। দেশে ফিরলেও প্রথমে আমাদের বাসায় যেতে দেয়া হয়নি। যখন প্রথম বাসায় গেছি তখন প্রধান টার্গেটই ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা খাতাগুলো সংগ্রহ করার। ওই সময় বাসায় থেকে আমরা কিছুই নিয়ে আসিনি, শুধুমাত্র নিয়ে এসেছিলাম কারাগারে থাকতে বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো। এত ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো খুঁজে পেয়েছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই খাতাগুলো পড়া আমাদের দু’বোনের জন্য যে ভীষণ কষ্টের ও বেদনার ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করে দুটি দেশ স্বাধীন করেছেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্যও বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল। পরে পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্ত করতে দীর্ঘ সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে দেখা করতে যাওয়ার সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে জড়িয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, কারাগারে বসে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ‘বাড়ির সবাই আমার কারাগারে থাকার বিষয়টি মেনে নিলেও বুঝতে পারত না ছোট্ট রাসেল। সে দেখা করতে এসেই বার বার আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইত। ছোট রাসেল কীভাবে এই পাষাণ প্রাচীর ভেদ করে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে, এটা তো বুঝত না। কিন্তু আমিও তো মানুষ, আমিও তাঁর জন্মদাতা পিতা। কী কষ্ট যে হতো।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭৫’-এর পর ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু পারেনি। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসে ফিরে এসেছেন। এখন আমার একটাই কাজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা, দেশের গরিব-দুখি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সরকার থেকে যখন একটা ভাল কাজ করি তখন মনে মনে ভাবি, আব্বা হয়তো সবই দেখছেন, ভাল কাজ দেখে খুশি হচ্ছেন। ভাল কাজ করলে বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি পাবেন, সেই লক্ষ্য নিয়েই দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা আরও অনেক লেখা ও তথ্য বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বই-ই শেষ নয়, আমাদের কাছে আরও অনেক লেখা ও তথ্য রয়েছে। ধীরে ধীরে সবই আমরা বই আকারে প্রকাশ করব। ২০২০ সালে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী পালন করব। আর জন্ম শতবার্ষিকীর মধ্যেই আমরা সব লেখা নিয়ে বই প্রকাশ করব। এ প্রসঙ্গে তিনি কারাগারে বন্দী থাকার সময় ওই সময়ে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এসবির রিপোর্টগুলো সংগ্রহের কথা জানিয়ে বলেন, একজন ব্যক্তির (বঙ্গবন্ধু) বিরুদ্ধে এসবি ওই সময় ৪৮টি ফাইল করেছিল, সেখানে হাজার হাজার রিপোর্ট রয়েছে। সেগুলো থেকেও আমরা অনেক কিছু সংগ্রহ করছি। এছাড়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এক শ’ অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেগুলোও ডকুমেন্ট আকারে তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি। যারা দেশের ইতিহাস ও স্বাধীনতা নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাদের এই দুটি বই এবং প্রকাশিতব্য বইগুলোও সবচেয়ে বেশি সহায়ক হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শুধু আমার পিতা নন, তিনি এদেশের সব জনগণের। এদেশের মানুষের জন্য আমার পিতা-মাতা, ভাইরা জীবন দিয়ে গেছেন। আমরা দু’বোনও বাড়িসহ সবকিছুই জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকে যেসব নেতার সুনাম করে অনেক কথা লিখেছেন, পরে অনেকেই তাঁর সঙ্গে বেইমানি করেছেন। বঙ্গবন্ধু যাঁর সম্পর্কে যা যা লিখে গেছেন, তার একটা লাইনও আমরা কাটিনি। যেভাবে লিখেছেন সেভাবেই বইয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। যারা পরে বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই মারা গেছেন। আর যারা বেছে আছেন তারা এই বইটি পড়ে নিশ্চয় কৃতকর্মের জন্য লজ্জা পাবেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। ইনশাল্লাহ আমরা তাঁর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবোই। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে হলে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ দুটো সবচেয়ে প্রয়োজন হবে। এই বই দুটি প্রকাশিত না হলে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস পরিপূর্ণতা পেত না। বই দুটি প্রকাশ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব রয়েছে। আমি দাবি জানাবো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন এই দুইটি বইকে ভিত্তি করে বস্তুনিষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবনী যেন তৈরি করে। ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতিকই নন, একজন ভাল লেখকও ছিলেন এই বই দুটিই তার বড় প্রমাণ। দেশের স্বাধীনতার জন্য এই মহান নেতাকে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, ১২ বছর অন্ধকার কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা পড়তে হবে, আত্মস্থ করতে হবে এবং তা অনুসরণ করতে হবে। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে মা ও মেয়ের মতো দেখতেন। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর শর্তহীন ভালবাসা ছিল গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, আদর্শ ও নীতি নিয়ে চলতেন এবং মানুষের ভালবাসা অর্জন করতে পেরেছেন বলেই জাতির পিতা হয়েছেন, আর ওই সময়ের অন্য নেতারা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। রাজনীতিতে সংবেদনশীলতা না থাকলে অমানবিক হয়ে যায়। যা এখন ঘটছে। আর বঙ্গবন্ধুই বিশ্বের একমাত্র নেতা যিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সাহস দেখিয়ে গেছেন, অন্য কেউ তা পারেননি।
×