ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চৈত্রেও পৌষের শীত উচ্চচাপ বলয়ের প্রভাব

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৮ মার্চ ২০১৭

চৈত্রেও পৌষের শীত উচ্চচাপ বলয়ের প্রভাব

শাহীন রহমান ॥ আবহাওয়ার খেয়ালি আচরণ শুরু হয়েছে প্রকৃতিতে। ষড়ঋতু যেন বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ছে। সময়মতো ঋতুর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। শীতকালে দেখা মিলছে না শীতে। বইছে না ফাল্গুনের দখিনা সমীরণ। অসময়ে ঝরছে বৃষ্টিপাত। বৈশাখ আসার আগেই শুরু হয়ে যাচ্ছে কালবৈশাখী। এর প্রভাবে একদিকে ফসলের ক্ষতি, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তেমনি জন স্বাস্থ্যের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এবার ফাল্গুনের শেষেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে বৃষ্টি ও বৈশাখী ঝড়। এর ফলে বিভিন্ন উঠতি ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের ওপর তার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বিগত শীত ঋতু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এবারের শীত ঋতুতে যথেষ্ট ঠা-া মেলেনি। অথচ অর্ধেক চৈত্রের শীতের আমেজ চলছে। আজ চৈত্রের ১২ দিন পেরিয়ে গেলে প্রকৃতি থেকে শীতের আমেজ কাটেনি। এখনও রাতে ঘুমানোর জন্য ব্যবহার করতে হচ্ছে গরম কাপড়। দিনের বেলায় গরমের দেখা নেই বললেই চলে। ফাল্গুনের শুরুতেই সঙ্গী হয়েছে বৃষ্টিপাত। মাঝে মাঝে দেশের বিভিন স্থানের অসময়ে বয়ে যাচ্ছে কালবৈশাখীও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন অসময়ের দেশে আলুসহ উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। যদিও তারা স্বীকার করছে এই সময়ে বৃষ্টিপাতের কিছু উপকারিতা রয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। কয়েক দিন ধরেই দেশে বিভিন্ন স্থনে চলছে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত। সঙ্গে রয়েছে উত্তুরে শীতল হাওয়া। ফলে শীতের আমেজ এখনও কাটছে না। অথচ তাদের মতে চৈত্রের এই সময়টাই প্রকৃতিতে বেশ গরমভাব থাকার কথা। আবহওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, মৌসুমি লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থানের কারণেই এই অবস্থা হচ্ছে। শনিবার সারাদিন আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। সকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট, রংপুর বিভাগের ডিমলা তেঁতুলিয়ায় বেশ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। রবিবার দেশে বিভিন্ন স্থানে ঝড়ো হাওয়া ও বজ্রসহ বৃষ্টি হওয়ার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। অবশ্য আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর এই সময়ে যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তা অনেকটা স্বাভাবিক। আবহাওয়া কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুস জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের শীত শেষ হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে অব্যাহত বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এ কারণে তাপমাত্রা বাড়েনি। ফলে এখনও রাতে শীতের আমেজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া তিনি বলেন, উত্তর-পশ্চিম বায়ু এখনও সক্রিয় রয়েছে। এ কারণে প্রকৃতিতে ঠা-া অনুভূত হচ্ছে। কয়েক আবহাওয়াবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বঙ্গোপসাগর থেকে দখিনা কোন বাতাস আসছে না। আসছে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। উত্তর পশ্চিম দিক থেকে আসা এই বায়ু ঠা-া শুষ্ক হয়ে থাকে। ফলে সূর্যের তাপ কমে গিয়ে ঠা-া অনুভূত হচ্ছে। তারা বলেন, এ সময় আবহাওয়া ঠা-া থাকার আরও একটি কারণ হলো উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয় নামে আবহাওয়ার বিশেষ অবস্থা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিরাজমান। উচ্চচাপ বলয়ের আওতায় যেসব এলাকা থাকে, তা খুবই ঠা-া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও বর্তমানে দৃশ্যত এখন আর ৬ ঋতুর দেখা পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইতোমধ্যে ঋতুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কারও কারও মতে, ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী তিনটি ঋতু আবার কার মতে চার ঋতুর অস্তিত্ব রয়েছে। কারও মতে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত ঋতুর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ হেমন্ত কাল যোগ করেছেন। তিন অথবা চার ঋতু যাই হোক না কোন ঋতুর সংখ্যা যে কমে এসেছে, আগের মতো আর ছয়টি ঋতুর সন্ধান যে পাওয়া যায় না তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে দিন দিন উল্লেখ করেন। তারা বলেন, ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন একটু বিশ্লেষণ করলে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত ঋতু হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি থেকে এ তিন ঋতুর আলাদা করে দেখাতে পাওয়া যায় না। গ্রীষ্ম বর্ষা ও শীত ঋতুর মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে এ তিন ঋতু। শরতের আবহাওয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বর্ষার মতো। ঋতু বৈচিত্র্য অনুযায়ী আষাঢ় শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও এ সময়ে ঠিকমতো বর্ষা আসছে না। প্রায় আষাঢ় বৃষ্টিহীন থাকছে। শ্রাবণেও কিছুটার বৃষ্টিপাত হলেও ভাদ্র আশ্বিনেই গিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন শরতের আবহাওয়া এখন বর্ষার মতো হয়ে পড়ছে। আষাঢ় শ্রাবণের গরমেও তাপমাত্রা বাড়ছে। আষাঢ় শুরু হওয়ার সময়ই মৌসুমি বায়ু প্রবেশের কথা থাকলেও এটি এখন আর সময়মতো আসছে না। দেরিতে আসার কারণে বৃষ্টিপাত দেরিতে শুরু হচ্ছে। ফলে বর্ষা শেষ হতে সময় লাগছে। শীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙ্গনে সর্বস্ব হারাচ্ছে দেশের নদীকবলিত এলাকার লোকজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হেঁয়ালি আচরণ চলছে বিশ্ব আবহাওয়াতেও। বিশ্বের এক অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিক খরা, অন্য অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ বন্যা, জলাবদ্ধতা। কোথাও ঘূর্ণিঝড়, কোথাও সাইক্লোন। কোন এলাকায় প্রচ- শীতের সঙ্গে পড়ছে মাত্রাতিরিক্ত বরফ; কোন কোন এলাকা হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে মানুষের জীবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতির নিয়মেই আবহাওয়ায় ক্রম বিবর্তন আসছে। এর সঙ্গে সব ক্ষতিকর কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে মানুষের সৃষ্ট নানা উপসর্গ। বেশ কয়েক বছর ধরেই আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণ চলে আসছে। চলতি বছরেও দেশের আবহাওয়া বেশ ব্যতিক্রমী আচরণ করছে। আবহাওয়া অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, আবহাওয়ার রেকর্ড গত দিক থেকে গড়বৃষ্টি রেকর্ড স্বাভাবিকের কাছাকাছি দেখালেও সেটা সমন্বিতভাবে হচ্ছে না। ফলে ওই বৃষ্টি কৃষিতে উপকারে আসছে কম। এতে দেশের গড় বৃষ্টির পরিমাণ ঠিক থাকলেও কৃষি আবহাওয়ার জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। এখন আসলে আবহাওয়া বিশেষ কোন নিয়মকানুন অনুযায়ী চলছে না। যে সময় গ্রীষ্মকাল আশা করা হচ্ছে সে সময় তা শুরু হচ্ছে না। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ষা রুটিন মতো হচ্ছে না। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত জটিলতা তৈরি হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। আবহাওয়া ও ঋতু পরিক্রমা স্বাভাবিক রাখার উপায় প্রসঙ্গে সার্ক মেটেওরলজিক্যাল সেন্টারের এক আবহাওয়াবিদ জানান, প্রকৃতির নিয়ম ও মানুষের সৃষ্ট বহুবিধ কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তন কেউ পুরোপুরি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবুজায়ন তথা বেশি বেশি গাছ লাগানো উচিত। সর্বোপরি দূষণ ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
×