ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মমতার বলি আরিফা

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২৪ মার্চ ২০১৭

নির্মমতার বলি আরিফা

গত ১৬ মার্চ নিজ বাসার সামনে সাবেক স্বামীর হাতে খুন হলেন নারী ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুন নেছা আরিফা। ডিভোর্সের কারণেই ক্ষিপ্ত হয়ে এই হত্যাকা-। এসব ক্ষেত্রে নির্মমতার বলি হচ্ছেন নারীরাই। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। নিজ পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে আরিফা ফখরুল ইসলাম রবিনকে ২০১৩ সালে বিয়ে করে ওঠে বাড্ডার একটি ভাড়া বাসায়। এর মধ্যেই ব্যাংকে চাকরি হয় আরিফুর নেছার। বিয়ের কয়েক মাস পরেই তাদের মধ্যে শুরু হয় কলহ। বিয়ের পর পরই আরিফা জানতে পারে রবিন মাদকাসক্ত এবং ২০১৬ সালের আগস্টে তাদের বিচ্ছেদ হয়। তাদের দু’জনের গ্রামের বাড়িও একই জেলায় জামালপুরে। তারপর থেকে সেন্ট্রাল রোডের ১৩ ওয়েস্ট এ্যান্ড স্ট্রিটের একটি বাসায় মাকে নিয়ে থাকতেন আরিফা। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ভাল একটি চাকরি নিয়ে জীবনকে যখন নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন তখনই এমন নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো সাবেক পাষ- স্বামীর হাতে। এরা দেখতে মানুষের মতো মনে হলেও এরা মানুষরূপী অমানুষ। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে রবিন বদরুল মতো অমানুষের সংখ্যা। অনেকে বলে থাকেন এসব ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এসবের পুনরাব্ৃিত্ত ঘটত না। মতের অমিল হলে তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই এমন ধারণা সুস্থ নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন ঘটনা এখন অনেকটা স্বাভাবিক রূপ নিয়েছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার ফল হিসেবে খুনোখুনী-সহিংসতা বাড়ছে। সমাজের মূলে আছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা ও বিশ্বাস। তাতে চিড় ধরেছে। কোন সমাজের পতন কেবল সেই সমাজের খারাপ লোকদের জন্যই ঘটে না, পতন ঘটে যখন ‘ভাল’রাও খারাপকে খারাপ বলতে দ্বিধা করেন। সঙ্কটের মূলে রয়েছে এই নৈতিক সমস্যা। যে মানুষটাকে কয়েক বছর আগে ভালবেসে বিয়ে করেছিল পরবর্তীতে ডিভোর্স হওয়ায় বা আরিফা তাকে ডিভোর্স দেয়ায় সে তা মেনে নিতে পারেনি। তাই তো চরম নির্মমভাবে হত্যা করল। একজন পুরুষ যেমন তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে মনমালিন্য না হলে তেমনি একজন নারীরও সে অধিকার আছে। আজ আরিফা খুন হয়েছে বলে আমরা তা জানতে পারলাম কিন্তু এ রকম হাজারো নারী নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তার স্বামীর হাতে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা নারী নির্যাতনের হার কমাতে পারিনি। হত্যা, ধর্ষণ, খুন প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে ঘরে বাইরে। ভাবতে লজ্জা হয় আমরা এমন এক দেশের নাগরিক যেখানে শিশুও নিরাপদ নয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রকাশ্যে একজন মেয়েকে কোপাতে পারে এমন দৃশ্য বড় দুর্ভাগ্যের বার্তাই বহন করে। কিংবা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া স্কুলের সামনে দর্জি দোকানের কর্মচারীর ছুরির আঘাতে প্রাণ হারান। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার আসামিকে আমরা আজ পযর্ন্ত শনাক্ত করতে পারিনি। গণমাধ্যমের তত্ত্ব বলে, কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তি সেই বিষয় সম্পর্কে মানুষের সংবেদনশীলতাকে ভোঁতা বানিয়ে ফেলে। যেমন টেলিভিশনে যুদ্ধের ছবি দেখতে দেখতে যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সংবেদনশীলতা আর কাজ করে না। এসব নির্যাতন দূরের কোন বিষয় নয়। ঘরে ঘরে তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা-আরিফা আর মেয়েশিশুরা রয়েছে। কাজেই অন্য যে কারণটি জোরালো বলে মনে হয় তা হলো, কোথাও সাহায্য নেই ধরে নিয়ে কেবল নিজের ঘরের মেয়েটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকেই সবার মনোযোগ নিবন্ধ। রয়েছে শ্রেণী প্রশ্ন। এ ধরনের নির্যাতন প্রান্তিক নারী বা শিশুর ক্ষেত্রেই মূলত ঘটেছে এতকাল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সব সমাজেই এমন ঘটনা ঘটছে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা নারীদের জন্য নিরাপদ একটি দেশ গড়তে পারিনি। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অন্তত দুই লাখ নারীর নির্যাতন অভিজ্ঞাতার ওপর দাঁড়িয়ে। যে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা হেঁটে চলে বেড়াই নিশ্বাস নিই, কবিতা পড়ি, জাতীয় সঙ্গীত গাই, সেই দেশের নির্মাণে এসব নারীর অংশীদারিত্ব শুধু নয়, ভয়াবহ আত্মত্যাগ রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে পুরুষেরা প্রায় সকলে প্রাপ্য সম্মান পেলেও নারীরা সেই তুলনাই পায়নি। তাই তো অনেক নারী আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন। হারিয়ে গেছেন। অনেকে ইতিহাসের আগুন বুকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। অনেকের যুদ্ধ আজও শেষ হয়নি। এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং নারীর আত্মত্যাগ আর নির্যাতনের ইতিহাসকে তাই আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা দেশে নারীর জন্য মুক্ত পরিসর আজও নির্মিত হলো না। গ্রামের কত মেয়ের শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যায় শুধু নিরাপত্তাহীনতার জন্য! এমনকি হাজারো মেয়ের বাল্যবিবাহ হয় শুধু এই নিরাপত্তাহীনতার ভীতি থেকে। ছেলেশিশু বড় হয় আর তার বিচরণ- পরিধি বাড়তে থাকে, কিন্তু মেয়েশিশু বড় হয় আর তার নিরাপত্তাহীনতা ভয়ের চাদর হয়ে ঘিরে থাকে তাকে। মেয়েশিশুদের এই নিরাপত্তাহীনতায় বাঁচতে বাধ্য হওয়া তাদের মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। যতদিন এ দেশে নারী ও শিশুর আর্তনাদ শোনা যাবে ততদিন নিজেদের সভ্য দাবি করার অধিকার আমাদের নেই। নারী পুরুষ উভয়ের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বাংলাদেশে। সবার জীবন নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে উঠুক এটাই আমাদের কাম্য।
×