ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশ উন্নয়নের জন্য কারও ওপর নির্ভরশীল নয়

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৪ মার্চ ২০১৭

বাংলাদেশ উন্নয়নের জন্য কারও ওপর নির্ভরশীল নয়

প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কখনই কোন বিদেশী রাষ্ট্র বা দাতাগোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করবে না। কারণ বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত উন্নয়নের জন্য কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে আর অবহেলা করা যায় না। এসব আন্তর্জাতিক সংস্থা- যারা কথায় কথায় মিথ্যা দোষারোপ করে তাদের কাছে নতজানু করে রাখতে চায়, তারা সে শিক্ষাটা পেয়ে গেছে। আর কেউ এভাবে মাথা নিচু করে চলার জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।’ ‘আমাদের বাৎসরিক উন্নয়ন কর্মসূচীর ৯০ ভাগই এখন আমরা নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে পারি’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। কানাডার ফেডারেল কোর্ট যার রায়েও বলেছে- এসব মিথ্যা, ভুয়া, বানোয়াট। এখানে অভিযোগের কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৭’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন। খবর বাসস’র। শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রথমেই ঘোষণা দিয়েছিলাম আমরা নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণ করব। আমরা আল্লাহর রহমতে নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণ শুরু করেছি। আমি অন্তত এটুকু বলতে পারি, এ সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর দিনবদলের সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর সরকার কাজ শুরু করে। ২০২১ সালে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনকালে দেশে কোন দরিদ্র থাকবে না, সে লক্ষ্যপূরণেই তাঁর সরকার দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। এ বছর ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে স্বাধীনতা পদক ২০১৭-তে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং উন্নয়নসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য এ পদক প্রদান করা হয়। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে তিন লাখ টাকার চেক, ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের একটি পদক ও সনদপত্র প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেনÑ গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব) শামসুল আলম বীরউত্তম, স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মকর্তা আশরাফুল আলম, শহীদ মোঃ নাজমুল হক, মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ মহসিন আলী (মরণোত্তর), শহীদ এনএম নাজমুল আহসান (মরণোত্তর), শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ (মরণোত্তর), চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যাপক ডাঃ এএইচএম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী, সাহিত্যে রাবেয়া খাতুন ও মরহুম গোলাম সামদানী কোরায়শী (মরণোত্তর), সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রফেসর ড. এনামুল হক ও নৃত্যকলায় ওস্তাদ বজলুর রহমান বাদল, সমাজকল্যাণে খলিল কাজী (ওবিই), গবেষণা ও প্রশিক্ষণে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও অধ্যাপক প্রয়াত ড. ললিত মোহন নাথ (মরণোত্তর) এবং জনপ্রশাসনে প্রফেসর মোঃ আসাদুজ্জামান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ শফিউল আলম স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন এবং স্বাধীনতা পদক বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তদের পক্ষে অধ্যাপক ড. এনামুল হক নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন। পদকপ্রাপ্তরা প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে পদক গ্রহণ করেন। আর বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল আবু এসরার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বাধীনতা পদক প্রহণ করেন। মরণোত্তর পদকের ক্ষেত্রে শহীদ মোঃ নাজমুল হকের পক্ষে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল ইসলাম হক, সৈয়দ মহসিন আলীর পক্ষে স্ত্রী সৈয়দা সায়রা মহসিন এমপি, শহীদ এনএম নাজমুল আহসানের পক্ষে ছোট ভাই এমএন সদরুল আহসান, শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের পক্ষে কন্যা সুফিয়া খাতুন, মরহুম গোলাম সামদানী কোরায়শীর পক্ষে পুত্র গোলাম ইয়াজদানী কোরায়শী এবং অধ্যাপক প্রয়াত ড. ললিত মোহন নাথের পক্ষে স্ত্রী আরতি নাথ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক প্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদক বিজয়ীদের সঙ্গে ফটোসেশনেও অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, চীফ হুইপ ও হুইপবৃন্দ, সুপ্রীমকোর্টের বিচারকগণ, সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাগণ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনিতিকবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার। এ বছর ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠানকে মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং উন্নয়নসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আমি অভিনন্দন জানাই। যারা মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। যারা পুরস্কার অর্জন করেছেন, আপনারা সমাজের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমাদের সমাজে যারা নিজেদের জীবনকে উন্নত করে গড়ে তুলতে চায়, তারা আপনাদের পথ অনুসরণ করবে। আপনাদের মেধা-মনন দিয়ে একটি প্রগতিশীল সমাজ আমরা গড়ে তুলতে চাই। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও এভাবে একটি আদর্শ নিয়ে গড়ে উঠবে এবং স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বের সঙ্গে অবদান রাখবে। একই সঙ্গে আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং পাকিস্তানীদের শোষণ-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালী জাতি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। তিনি বলেন, আগরতলা মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আটক করা হয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনে বাঙালী। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহনা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকটাই জেলে কেটেছে বঙ্গবন্ধুর, বলেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালী জাতি নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন এবং সমগ্র জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেন। প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রমহারা নারীদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ প্রসঙ্গে বলেন, বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনা থেকে শুরু করে সে সময় জন্মানো শিশুদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসনের কাজ সবই বঙ্গবন্ধু করেছেন। যাদের পরিবার গ্রহণ করতে চায়নি সেসব দুঃস্থ নারীর অনেককেই নিজে পিতৃ পরিচয়ে বঙ্গবন্ধু বিয়ের ব্যবস্থা করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘লিখে দাও বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ঠিকানা ধানম-ি ৩২ নম্বর।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু এমন কোন ক্ষেত্র নেই যে বিষয়ে পদক্ষেপ নেননি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয় এবং তখন থেকেই এ দেশে হত্যা, ক্যু এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতির গোড়াপত্তন করে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে দেশকে পিছিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের শুরু হয়।
×