ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশে মোট ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার একর;###;চাষযোগ্য জমি মাত্র ২ শ’ কোটি একর, এক-চতুর্থাংশই হুমকির মুখে;###;দৈনিক ৫৫০ একরের বেশি জমি অকৃষিতে যাচ্ছে;###;ইচ্ছামতো সব ধরনের জমির ব্যবহার;###;নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন দ্রুত চূড়ান্ত করার তাগিদ

জমি সুরক্ষায় চার ধরনের জমি চিহ্নিত করার পরামর্শ ॥ হুমকিতে কৃষি জমি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৪ মার্চ ২০১৭

জমি সুরক্ষায় চার ধরনের জমি চিহ্নিত করার পরামর্শ ॥ হুমকিতে কৃষি জমি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ চার ধরনের গুরুত্বপূর্ণ জমি চিহ্নিত করে নতুন ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন-১৭’ চূড়ান্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে মোট ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার একর। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমি রয়েছে মাত্র ২শ’ কোটি একর। এর এক-চতুর্থাংশই এখন হুমকির মুখে। বছরে বাড়ছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। দিনে ৫৫০ একর বেশি কৃষি জমি অকৃষি খাতে যাচ্ছে। বছরে কমছে ৮২ হাজার হেক্টর জমি। যা মোট জমির এক ভাগ। বছরে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে এক হাজার হেক্টর জমি। ৮০ শতাংশ সরকারী খাস জমিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। নির্মাণকাজের কারণে বছরে বিলীন হচ্ছে তিন হাজার হেক্টর জমি। গত ৩৮ বছরে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে! এমন বাস্তবতায় কৃষি জমি রক্ষায় নতুন আইনের বিকল্প নেই। এই আইনের মাধ্যমে কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলেও মনে করছেন তারা। যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনটি চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জমি চিহ্নিত করার পরামর্শ ॥ অন্তত চার ধরনের জমি চিহ্নিত করে আইন চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জমি চিহ্নিত না করে আইন কার্যকর কঠিন হবে। এতে সঙ্কট আরও বাড়বে। প্রকৃত অর্থে জমি সুরক্ষা কঠিন হবে। তেমনি জমির যথেচ্ছ ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এ জন্য কৃষি জমি, বনভূমি, জলাভূমি ও মানব-বসত ভূমি চিহ্নিত করা বাধ্যতামূলক। তারা বলছেন, জমি চিহ্নিত করা হলে কাজ করতে সহজ হবে। পাশাপাশি বসত জমিতেই হবে ইন্ডাস্ট্রি, রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ সকল প্রকার উন্নয়নমূলক কাজ। উন্নয়নের জন্য বসতি জমির পরিমাণ বেশি রাখলেও সমস্যা হবে না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও নগর বিশেষজ্ঞ নূরুল ইসলাম নাজেম জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষায় আইন করা খুবই জরুরী ছিল। আমরা অনেক দিন থেকেই এ দাবি জানিয়ে আসছিলাম। আশার কথা, অনেক দিন পরে হলেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনের খসড়ায় কিছুটা ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে। জমি চিহ্নিত না করে আইন হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে। সবার আগে আমাদের উচিত হবে জমি চিহ্নিত করা। কোনটি বসতি, জলা, কৃষি ও বনভূমি। মূলত, এই চার ধরনের জমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এসব জমি চিহ্নিত করে পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। তারপর এলাকাভিত্তিক জমি বাছাই করা সহজ হবে। এখন জমিতে স্থাপনা ওঠার পর সরকার বাধা দিলে এটি কোন ধরনের জমি ছিল তা প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে না। চিহ্নিত করা থাকলে কেউ ইচ্ছেমতো জমির ব্যবহার করতে পারবে না। তেমনি আইনের শতভাগ প্রয়োগ সম্ভব বলেও মনে করেন এই নগরবিদ। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, জমি চিহ্নিত করে আইনে যুক্ত করতে হবে। তারপর আইনটি চূড়ান্ত করতে হবে। এতে দেশের সকল মানুষের উপকার হবে। যারা আইন নিয়ে সমালোচনা করছেন কিংবা হতাশা প্রকাশ করছেন সরকারের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। সব আইনের ক্ষেত্রেই কিছু বিরোধিতা থাকে। আমি মনে করি, এই আইনটি খাদ্য নিরাপত্তা ও জনকল্যাণে খুবই কার্যকর হবে। ভূমি ব্যবহারে অনুমোদন বাধ্যতামূলক ॥ নগরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বাড়িঘর নির্মাণ এবং যে কোন উন্নয়ন কাজে ভূমি ব্যবহারের প্রয়োজনে স্থানীয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগবে। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে গ্রামাঞ্চলে ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতির বিধান থাকলেও সেটি প্রতিপালিত হয় না। এখন এই বিধান যুক্ত করে ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন-২০১৭’-এর খসড়া মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এই নিয়ম না মানলে পাঁচ বছর কারাদ-ের সঙ্গে ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ১৯৫০-এর আইনে শাস্তির বিধান ছিল না। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছিল কৃষি জমি সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইন করার। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন, যেভাবে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ এ খাতের জমি ব্যাহত হবে। যা খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছিলেন তারা। এর মধ্য দিয়েই ২০১০ সাল থেকে আইন করা কথা বলা হচ্ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। যার খসড়া প্রায় সাত বছর পর মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন পেল। জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, আইনটিতে মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এখন এটি আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে। বিধিবিধান প্রণীত হবে। সে ক্ষেত্রে কোথায় কোন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেবেন সেটি চূড়ান্ত থাকবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্ষেত্রমতে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদন দিয়ে থাকে। ঢাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক এ ধরনের অনুমোদনের জন্য দায়িত্ব পালন করে। ভবিষ্যতে এই ক্ষমতা ক্ষেত্রমতে ইউনিয়ন পরিষদের হাতেও দেয়ার সুযোগ রয়েছে এই আইনে। ভূমি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এই আইন করা হচ্ছে বলে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে যেন জমির ব্যবহার করা হয়, সে জন্য আইনে অনেকগুলো প্রস্তাব আছে। খসড়ায় গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২৭ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাদের মূল দায়িত্ব হবে নগর উন্নয়ন অধিদফতর বা তাদের ছোট পরিষদের তত্ত্বাবধান করা। এছাড়া গণপূর্ত সচিবের নেতৃত্বে থাকবে ২৫ সদস্যের নির্বাহী পরিষদ। পূর্তমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ মূলত নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে কাজ করবে। আর উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে নির্বাহী পরিষদের কাজ। এছাড়া জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের কাছে পরিকল্পনাগুলো সুপারিশসহ উপস্থাপন করবে নির্বাহী পরিষদ। বছরে এক শতাংশ হারে কমছে কৃষি জমি ॥ নতুন আইন প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সকল সরকারী-বেসরকারী সংস্থা, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যাদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা এবং ভূমি ব্যবহার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। সেসব সংস্থা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে উপদেষ্টা পরিষদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদ ছাড়পত্র দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দিতে পারবে। রাজউকসহ এ সংক্রান্ত অন্য কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয় করবে উপদেষ্টা পরিষদ। নগর উন্নয়ন অধিদফতরকে নগর ও অঞ্চলের পরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার ব্যবস্থাপনা প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব দেয়া যাবে। এ আইনের অধীনে প্রণীত পরিকল্পনা, বিধি, কোন আদেশ, নির্দেশ মোতাবেক কাজ না করলে বা কোন ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এগুলো লঙ্ঘন করলে দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল বলেন, গ্রাম এলাকাতেও কোন উন্নয়নমূলক কাজ করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলো তাদের এখতিয়ারভুক্ত এলাকাগুলোতে নিজেরাই অনুমোদন দেবে। পৌরসভা ও স্থানীয় পরিষদ নিজেদের গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকা- সম্পাদন করবে। ইতোপূর্বে তারা যেসব কাজ করছে তা এই আইনের মধ্যে গণ্য হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে ‘মানুষের বাড়িঘর নির্মাণের বিষয়টিও’ আছে। ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়টি গ্রাম পর্যায়ে চলে যাবে। সারা দেশের যে কোন জমি ব্যবহার করতে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগবে। সচিব বলেন, গ্রামে বাড়িঘর তৈরির আগে ইউনিয়ন পরিষদের অনুমতি নেয়ার নিয়ম এখনও আছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নেয়া হয় না। কৃষি জমিতে বাড়ি করতে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু মানুষ সাধারণত সেই অনুমতি নেয় না। এগুলো আইনে আছে, পালন করা হয় না। নতুন আইন তৈরির যৌক্তিকতা তুলে ধরে শফিউল আলম বলেন, জমির অপব্যবহার ঠেকানো এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পরিকল্পনা করে যেন ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। জমির অপব্যবহার যেন কম হয়। প্রতিবছর এক শতাংশ করে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সেটা ঠেকানো দরকার। প্রস্তাবিত নতুন আইনে যেসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা নেই, সেগুলো বিধির মাধ্যমে বিষদ করা হবে বলে জানান তিনি। অপরিকল্পিত জমির ব্যবহার রোধ জরুরী ॥ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি রক্ষায় রাষ্ট্রের সমন্বিত কোন পরিকল্পনা না থাকায় অপরিকল্পিতভাবে চলছে জমির ব্যবহার। যেখানে সেখানে হচ্ছে বাড়ি। নির্মাণ করা হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার দোকানসহ বিভিন্ন রকমের স্থাপনা। সব মিলিয়ে কৃষি জমি দ্রুত অকৃষি খাতে যাচ্ছে। সংরক্ষিত ভূমি বলতে কিছু নেই। তবে জলাধার, বন, পাড়ার রক্ষায় আইন ও নীতিমালা থাকলে সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবে এর তোয়াক্কা করছেন না কেউ। ভূমিদস্যুদের কাছে এসব আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অসহায়! নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন জমি কমার মূল কারণ। দ্রুত ভূমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। কমছে কৃষি জমি ॥ দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। এ তিন-চতুর্থাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা চলে কৃষি উৎপাদন ও কৃষি বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে। প্রতিবছর দেশের ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর চাষাবাদ যোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৭৬২ মিলিয়ন হেক্টর। গত ৩৮ বছরের এ জমির পরিমাণ কমেছে ১ দশমিক ২৪২ মিলিয়ন হেক্টর। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য কৃষি জমি অকৃষি জমিতে পরিণত হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমি কমতে কমতে প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে কৃষি জমি কমতে থাকলে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা চরম হুমকির সম্মুখীন হবে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমি রয়েছে মাত্র ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। এর এক-চতুর্থাংশই এখন হুমকির মুখে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, বছরে বাড়ছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। দিনে ২২০ হেক্টরের বেশি কৃষি জমি অকৃষি খাতে যাচ্ছে। বছরে কমছে ৮২ হাজার হেক্টর জমি। যা মোট জমির এক ভাগ। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮০৪টি। তাদের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। কৃষি জমি অকৃষিতে রূপান্তরিত হওয়ায় এ প্রান্তিক কৃষকরা সংসারের হিসেব মিলাতে পারছে না। এসআরডিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগওয়ারি অকৃষি খাতে জমি চলে যাওয়ার প্রবণতা চট্টগ্রাম বিভাগে বেশি। এ বিভাগে প্রতিবছর ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ১৫ হাজার ৯৪৫ হেক্টর, ঢাকায় ১৫ হাজার ১৩১ হেক্টর, খুলনায় ১১ হাজার ৯৬ হেক্টর, রংপুরে ৮ হাজার ৭৮১ হেক্টর, বরিশালে ৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমি প্রতিবছর অকৃষি জমিতে পরিণত হচ্ছে। কৃষি জমি অকৃষি জমিতে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন। আর কিছু জমি অকার্যকর হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষাবাদের কারণে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৩১৯টি পৌরসভার মধ্যে ৩০টিতে ‘তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ প্রকল্প’-এর কাজ চলছে। এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে নগরকেন্দ্রিক সব উন্নয়ন প্রকল্পে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা। এলাকাবাসীর মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প হবে। এছাড়া ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনের মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডের বাসিন্দা অংশ নেবেন। তারাই ঠিক করবেন নিজেদের এলাকায় উন্নয়ন কিভাবে হবে। স্থানীয়ভাবে কয়টি বাজার, স্কুল, বাড়ির আকৃতি, শিল্প স্থাপন হবে কি হবে না, এলাকার কোন কোন অংশের জমি ব্যবহার করা যাবে তা নিশ্চিত হবে প্রকল্পের মধ্য দিয়ে। এ কাজে সহযোগিতা করবেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীরা। নতুন পরিকল্পনার বাইরে যেখানে সেখানে ইচ্ছা করলেই জমির ব্যবহার করা যাবে না। কৃষি জমি কমার কারণ ॥ কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে মূল বলে মনে করেন অনেকেই। বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে ঘরবাড়ি তৈরির জন্য ব্যবহƒত হচ্ছে ভূমি। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বসতবাড়ির সংখ্যা ছিল দুই কোটি সাড়ে ৪৮ লাখ। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বসতবাড়ির সংখ্যা তিন কোটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩০। বসতবাড়ি এলাকার পরিমাণ ১৯৯৬-২০০৮ সময়ে তিন লাখ ৫২ হাজার একর থেকে বেড়ে ছয় লাখ ৭৭ হাজার একরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব উন্নয়ন সূচক ২০০৯’ থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সালে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করত। ২০০৭ সালে তা বেড়ে হয় ২৭ শতাংশ। বৃদ্ধির এ হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা নিয়ে নতুন শহর হচ্ছে। বাড়ছে রাস্তাঘাট। নির্মাণকাজের কারণেও জমি কমছে ॥ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর তিন হাজার হেক্টর জমি বিলীন হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ১০ বছরে আবাদি জমি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়, দেশে মোট জমির পরিমাণ ১৪ দশমিক চার মিলিয়ন হেক্টর। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এ জমি ভাগ করলে জনপ্রতি পাবেন ২৪ শতাংশ, চাষযোগ্য জমি পাওয়া যাবে ১৫ শতক। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো বছরে বাড়ছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। কমছে দুই লাখ একর কৃষি জমি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে আবাদি যোগ্য জমি ছিল ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। ২০০০ সালে তা কমে ৭১ লাখ ৯ হাজার হেক্টরে আসে। ২০০৩ সালে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়ায়। গড়ে প্রতিবছর ৪০ হাজার একর আবাদি জমি হারাচ্ছে। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ সরকারী খাস জমির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৭২-২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৬ একর জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। এ খাতে চলে যাওয়া জমির মধ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে ৬৪ হাজার ৪৮৯ একর জমিতে। দোকান নির্মাণ হয়েছে ৬ হাজার ২৬২ একর জমিতে। কলকারখানা নির্মাণ হয়েছে ২২২ একর জমিতে। বিদ্যালয় দুই হাজার ৮২৭ একর, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ৪৯৯ একর ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে এক হাজার ৯৯৯ একর জমিতে। সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কৃষি জমি বিলুপ্তির প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল পরবর্তী ১২ বছরে দেশে প্রতিবছর ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। ইটভাঁটির উপদ্রব ॥ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ইটভাঁটি। রাজধানীর আশপাশে পরিকল্পনাহীনভাবে ইটভাঁটি গড়ে উঠার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর। পরিবেশ অধিদফতরের হিসেবে দেশে ইটখোলা আছে চার হাজার ৫১০। এগুলোয় প্রতিবছর পোড়ানো হয় অন্তত তিন হাজার ২৪০ কোটি ইট। তবে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসেবে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ইটখোলার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। খোলার প্রতিটিতে তৈরি হয় বছরে ৭৫ লাখ ইট। ইটপ্রতি মাটির পরিমাণ গড়ে তিন কেজি ধরলেও সাড়ে ১৩ কোটি টন মাটি লাগে, যে কারণে বছরে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমি (দুই ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি কাটা হলেও) ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়। কৃষিবিদ ও মৃত্তিকা গবেষকরা বলেছেন, ছয় হাজার ইটখোলার দখলে রয়েছে (প্রতিটি গড়ে সোয়া আট একর) প্রায় ৫০ হাজার একর আবাদি জমি। দেশে দুই কোটি ৮৩ লাখ পরিবার ॥ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, দেশে মোট পরিবারের সংখ্যা দুই কোটি ৮৩ লাখ ৯৫ হাজার ৭৩। মোট কৃষি পরিবারের সংখ্যা এক কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩। মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ৮৫ লাখ পাঁচ হাজার ২৭৮ দশমিক ১৪ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমির পরিমাণ ৭১ লাখ ২৪ হাজার ৮৯৫ দশমিক ৪১ হেক্টর। আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬ দশমিক ২৪ হেক্টর, দেশে বর্তমানে তিন ফসলি জমির পরিমাণ রয়েছে ১৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬২ দশমিক ৭৯ একর। এছাড়াও মোট ফসলি জমির পরিমাণ এক কোটি ৫০ লাখ ৩৪ হাজার ৭১ দশমিক ৬০ হেক্টর। ডিজিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৬ দশমিক ৩৩ ভাগ। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৯ দশমিক ৪১ ভাগ। বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বৃহৎ জনবসতির দেশ হিসেবে সবার আগে বাংলাদেশে ভূমি ব্যবহারের জন্য নীতিমালা থাকা উচিত। হল্যান্ড, তাইওয়ান, ইসরাইলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভূমির ব্যবহার করা হচ্ছে। সেসব দেশে এক ইঞ্চি জমিও পরিকল্পনার বাইরে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। দেশে সাড়ে তিন কোটি একর জমির মধ্যে দুই কোটি একরের কিছু বেশি কৃষি জমি রয়েছে। এসব জমি দ্রুত বিভিন্ন খাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। আইনের মাধ্যমে সবার আগে কৃষি জমি হ্রাস বন্ধ করতে হবে পাশাপাশি জমি ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ জরুরী বলেও পরামর্শ দেন তিনি।
×