ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার দিনগুলো এখন ধুলোয় লুটোচ্ছে। ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে রাজধানীর এই ‘প্রজা-দশা’ দেখে আসছি ফিবছর। ধূলিধুসর দুপুর বেলাগুলো সবচাইতে করুণ। গরমে তখন কিছুটা হাঁসফাঁস দশা। সক্কালবেলা থেকে যানবাহন আর মানুষের চাপে ধ্বস্ত রাজপথগুলো ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায়; তারপর ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিতে চায় তার অস্বস্তি। ফলে মানুষের অস্বস্তি বাড়ার শুরু তখনই। এই ধুলো থেকে মুক্তির কী উপায়? আমাদের মেয়রদ্বয় কিছু ভাবছেন কি? গ্যাস সিলিন্ডার বিষয়ক সতর্কতা লালবাগ ঢাকার পুরনো ঐতিহ্যবাহী একটি এলাকা। সেখানে ঐতিহাসিক নিদর্শন কেল্লা দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। আবার ঢাকাইয়া মিষ্টি ও অন্যান্য খাবার কেনার জন্যও শাহবাগ-ধানম-ি এলাকার বাসিন্দারা লালবাগে যান। শনিবার সেখানে যে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটেছে তার বিবরণ পড়তে গেলে শিউরে উঠতে হয়। জনকণ্ঠের এক সহকর্মী ওই বিস্ফোরণের আগে-পরে অকুস্থলের কাছাকাছি ছিলেন। তাই তার বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শীরই বর্ণনা। তিনি বললেন মিষ্টির দোকানের কোমর সমান উঁচু বেশ চওড়া ফ্রিজ উড়ে গিয়ে রাস্তার উল্টোদিকের এটিএম বুথে গিয়ে আঘাত হানে। সেখানে টাকা উত্তোলনরত এক মহিলা গুরুতর আহত হন। ঢাকায় বাসাবাড়িতে এবং বিভিন্ন যানবাহনে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনও সময় এগুলো বিস্ফোরিত হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে সেফ সিলিন্ডার ক্যাম্পেইন নামে অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। মাস দুয়েক আগে বিবিসির প্রতিবেদনে পড়েছিলাম বিস্তারিত। বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে এবং বিভিন্ন যানবাহনে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তা কতটা নিরাপদ সে সম্পর্কে ওই ক্যাম্পেইনের একজন কর্মকর্তা বলেন, নির্দিষ্টভাবে গবেষণা নেই। বিস্ফোরক অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্যে একটা সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট লাইফটাইম থাকে। দশ বছর ১৫ বছর। এর পর সেগুলো ধ্বংস করে ফেলতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গাড়িতে যেটা ১০ বছর বা ১৫ বছর আগে লাগানো হয় সেটা এখনও চলছে। সেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। গত অক্টোবরে বিস্ফোরক অধিদফতর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করে সেগুলোর মধ্য থেকে আট হাজার সিলিন্ডার বাতিল করে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ কেন হয়? যেটুকু জানতে পেরেছি তা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করা জরুরী। কোন কারণে গাড়িতে আগুন লাগলেই যে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হবে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আগুন যদি সরাসরি সিলিন্ডারের ভেতরের গ্যাসের সংস্পর্শে যেতে পারে, অথবা খুব বেশি তাপ যদি সরাসরি সিলিন্ডারকে তপ্ত করে তোলে তাহলেই কেবল দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর প্রতিকারের জন্য মানসম্পন্ন সিলিন্ডারে একটি ভালভে বিশেষ ব্যবস্থা থাকে, যা আগুন বা উচ্চ তাপে যেন দুর্ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করে। অত্যন্ত উচ্চ চাপে সিলিন্ডারের ভেতর গ্যাস ভরা হয়। এই চাপ প্রায় তিন হাজার পিএসআই (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি)। তাই গ্যাস সিলিন্ডার বেশ পুরু ইস্পাত দিয়ে তৈরি করা হয়, যার কার্যকর ক্ষমতাও তিন হাজার পিএসআই, যা কেবল ছয় হাজার ৬০০ পিএসআইয়েরও বেশি চাপে বিস্ফোরিত হতে পারে। সুতরাং এসব নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিক থাকলে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আশঙ্কা কমে যায়। যেসব কোম্পানি অকটেন বা পেট্রলের পরিবর্তে গ্যাসে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করে, তাদের প্রধান দায়িত্ব এটা দেখা যে সিলিন্ডার যেন উপযুক্ত মানসম্পন্ন হয়। যেহেতু এসব গাড়ি তৈরি করা হয়েছে পেট্রলে চালানোর জন্য, তাই সেখানে সিলিন্ডারের কোন বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অর্থাৎ কৃত্রিম উপায়ে এসব গাড়িকে গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয়। যে কোন কৃত্রিম ব্যবস্থায় কিছু ঝুঁকি থাকে। গ্যাসচালিত গাড়িতেও সেই ঝুঁকি সম্পর্কে সব সময় সতর্ক থাকা দরকার। প্রথম গ্যাস সিলিন্ডার স্থাপনের পর চার-পাঁচ বছর অন্তর নিবিড় পরীক্ষা করলে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। অনেক সময় চালক অসৎ উদ্দেশ্যে নতুন সিলিন্ডার বিক্রি করে কম দামে পুরনো ও জরাজীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা থাকে। কোন অবস্থাতেই জরাজীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করা উচিত নয়। আবার গ্যাস সংযোজনের পাইপগুলো যদি পুরনো হয়ে গ্যাস লিক করে তাহলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এসব ত্রুটি না থাকলে সাধারণত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার কথা নয়। সুতরাং সতর্কতাই এসব গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ রোধের নির্ভরযোগ্য উপায়। প্রতিটি এলপিজি সিলিন্ডারের একটা এক্সাপায়ারি ডেট বা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ আছে। তার পরে ব্যবহার মানেই বিপদ। তাই আগেই দেখে নেওয়া দরকার। গ্যাসের কোনও মেয়াদ থাকে না না, কিন্তু প্রতিটি সিলিন্ডারের একটি মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ থাকে। সেটা দেওয়াও থাকে। আর তা অতিক্রম হওয়া সিলিন্ডার ব্যবহার করা মানে ঘরে একটা মস্ত বড়, মারাত্মক বিস্ফোরক নিয়ে বাস করা। জেনে নিন কী করে দেখা যায়? সিলিন্ডার-এর উপরে যে রিং দেওয়া থাকে তার ভেতরের দিকে এমন ধরনের ঈ-২০, অ-১৫ ইত্যাদি লেখা দেখতে পাবেন। এটিই হলো মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ। বছরের ১২ মাসকে চারটি ভাগ করা থাকে। অ – জানুয়ারি থেকে মার্চ; ই – এপ্রিল থেকে জুন; ঈ– জুলাই থেকে সেপ্টম্বর; উ – অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। এর পরে যে সংখ্যাটি থাকে তা হলো বছর। অর্থাৎ কোনও সিলিন্ডারে অ-২০ লেখা থাকলে সিলিন্ডারটির এক্সপায়ারির সময় ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ। রান্নাঘরে কোনভাবে আগুন বা উচ্চ তাপ সরাসরি সিলিন্ডারের সংস্পর্শে আসে, তা হলে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আশঙ্কা থাকে। অত্যন্ত উচ্চচাপে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয়। অর্থাৎ, বিস্ফোরণ ঘটলে তা হবে অত্যন্ত জোরালো। তবে একটি কথা মনে রাখা ভাল। নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিকঠাক রাখলে, বিস্ফোরণের আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে। এবারে প্রশ্ন, কীভাবে রান্নাঘরের সিলিন্ডারের যতœ নেবেন যাতে বিস্ফোরণের আশঙ্কা একেবারে কমে যায়? ১. প্রথমেই দেখে নিন, চুলা এবং সিলিন্ডারের মধ্যে পাইপ সঠিকভাবে লাগানো আছে কি না। ২. এই পাইপ কোথাও নষ্ট হতে শুরু করেছে কি না, তা-ও দেখে নিন। সামান্য ত্রুটি চোখে পড়লেই বদলে ফেলুন। ৩. সিলিন্ডারের কাছাকাছি কোনও পদার্থ, যা থেকে বড় ধরনের আগুন ছড়াতে পারে, রাখবেন না। ৪. সিলিন্ডারের ‘নব’ থেকে গ্যাস লিক করছে কি না, নিয়মিত পরীক্ষা করুন। ৫. সিলিন্ডারের ‘নব’ ঘোরানোর সময়ে গ্যাস বেরোচ্ছে কি না, দেখে নিন। যদি সামান্য বেরোয়, সমস্যা নেই। যে চাপে গ্যাস সিলিন্ডারে রাখা থাকে, তাতে ওইটুকু স্বাভাবিক। কিন্তু একটু বেশি হলেই সতর্ক হতে হবে। ৬. রান্নার সময়ে গ্যাস বেরোচ্ছে কি না, সেটাও খেয়াল রাখুন। ৭. গ্যাস ডেলিভারির সময়েই চেক করিয়ে নিন সিলিন্ডারের ভেতরের ওয়াশার। ৮. সিলিন্ডারের উপরে ভারি কিছু রাখবেন না। বইমেলায় শেষ বেলায় আজ শেষ হচ্ছে ভাষার মাস। একুশের বইমেলারও ঝাঁপি বন্ধ হওয়ার কথা। অবশ্য প্রত্যেক বছরই প্রকাশকদের পক্ষ থেকে বইমেলার সময় বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। সে আহ্বান অরণ্যে রোদনেরই শামিল। গত মাসে বাণিজ্যমেলা চলল। জানুয়ারির ৩১ তারিখে তা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আরেকটি শুক্র-শনিবার পাওয়ার জন্য বিক্রেতাদের সুবিধার্থে মাসব্যাপী ওই মেলা চারদিন বাড়ানো হয়। বইমেলার বিক্রেতাদের ব্যবসার কথা বিবেচনা করলে আরও একটি শুক্র-শনিবার তাদের পাইয়ে দিতে হলে একইভাবে মেলার সময় চার দিন বাড়াতে হবে। সেটা কি বাড়বে? বাড়বে না। কী আর করা। এই লেখা যারা পড়ছেন, সেইসব ঢাকাবাসী বইমেলায় গিয়ে ছাড়কৃত মূল্যে নতুন-পুরনো সব ধরনের বই কেনার শেষ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেন। মেলার শেষ ক’টা দিন নিয়মিত যাওয়ার চেষ্টা করেছি। একুশের পরবর্তী শুক্রবার শুধু ফিরে আসতে হয়েছে রওয়ানা দিয়েও। এত ভিড়! আর মেলামুখী যানবাহনের গতিও ছিল কচ্ছপকে জিতিয়ে দেয়ার মতো। যা হোক, শনিবার গিয়ে দেখি যথেষ্ট ভিড়। এই ভিড় শুধু দর্শনার্থীদের ভিড় নয়, বই ক্রেতাদেরও ভিড়। সেটাই স্বস্তি। নামকরা প্রকাশকদের স্টল ছাড়াও স্বল্পপরিচিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলেও প্রচুর পাঠকের সমাগম। দেখতেও ভাল লাগে। কুয়াশার গল্প আত্মজাতুল্য রাজকন্যা টেক্সট করে জানাল বইমেলায় প্রবেশে তার দেরি হচ্ছে, তাই আমি যেন তার জন্য কুয়াশা ১ ও ২ কিনে রাখি। খুঁজে খুঁজে আরাধ্য স্টলটিতে গেলাম। কাজী আনোয়ার হোসেন এখনও কুয়াশা লিখছেন, এমন তথ্য তো আমার জানা ছিল না! বই দুটি হাতে নিয়ে ভুল ভাঙল। এটি এফএম রেডিওর কুয়াশা অনুষ্ঠানে প্রচারিত গল্পগুলোর সংকলন। অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা, প্রযোজনা ও উপস্থাপনা আরজে শারমিনের। বইয়ের ব্লার্বে চেহারা দেখেই চিনলাম। শারমিনকে দেখেছি আমার সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি যে পত্রিকায় হয়েছিল সেই সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীর কার্যালয়ে। ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে। শারমিন হচ্ছেন ওই পত্রিকার সম্পাদক, কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব গাজী শাহাবুদ্দীনের কন্যা। এবিসি রেডিও ৮৯.২ এফএমে প্রতি সোমবার রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত প্রচারিত হয় ‘কুয়াশা’। রেডিওতে এমন একটি অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা কীভাবে মাথায় এলো সে সম্পর্কে শারমিন জানাচ্ছেনÑ ‘ ছোটবেলা থেকেই ভৌতিক ও রোমাঞ্চধর্মী গল্প আমার খুব ভাল লাগত। শৈশবে গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। শার্লক হোমস, ব্যোমকেশ বক্সী আমার প্রিয় কয়েকটি চরিত্র। সেভাবেই আসলে ‘কুয়াশা’র মতো একটি রেডিও অনুষ্ঠান করার ভাবনা মাথায় আসে। তা ছাড়া আমি বরাবরই নতুন কিছু করার চেষ্টা করি। যা আগে কেউ করেনি, যা অন্যদের নতুন করে ভাবায়, তেমন কাজ করতে ভালোবাসি।‘ প্রথম দিকে সত্যি ঘটনা ও বিখ্যাত লেখকদের গল্প নিয়ে অনুষ্ঠানটা সাজানো হতো। এরপর এতে মৌলিক গল্প যুক্ত হয়। অনুষ্ঠানে চিত্রনাট্যকারের একটি দল আছে। আবার শ্রোতারাও গল্প লিখে পাঠান। শ্রোতাদের লেখা গল্প নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজনও হয়েছে। অনেক বিখ্যাত রোমাঞ্চধর্মী গল্প নিয়েও রেডিও নাটক তৈরি করা হয়েছে। এভাবেই অনুষ্ঠানটিতে নিত্যনতুন বিষয় যুক্ত হয়ে চলেছে। অনুষ্ঠানটি করতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতার কথা জানতে গিয়ে শারমিন বলছেন, ‘অনুষ্ঠানে যখন ভৌতিক গল্পগুলো বর্ণনা করা হয়, তখন রহস্যজনক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নেপথ্যে সে রকম সুর বাজানো হয়। একবার অনুষ্ঠান চলাকালীন কী যেন একটা পড়ে ‘টুং’ করে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভয় পেয়ে স্টুডিও থেকে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিলাম!’ বইমেলায় কুয়াশার গল্প কিনছেন রেডিওর শ্রোতারাই মূলত। এর সিংহ ভাগই তরুণ-তরুণী। এদের চিন্তাজগতে যদি বুদ্ধি করে নৈতিকতা, আদর্শবোধ, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম জাগিয়ে তোলা যায় তবে একটা কাজের কাজ হয়। আমি সেকথাই ভাবছিলাম। আরজে শারমিন, আপনিও কি ভাববেন? অন্তিম অভিবাদন সুলেখক গবেষক মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন বহতা সময়ই ব্যক্তির জন্ম দেয়, আবার ব্যক্তিও সময়কে নতুন তাৎপর্য দিয়ে নির্মাণ করে থাকেন। একজন ব্যক্তি, যিনি মানিক মিয়ার মতো দিকপাল সাংবাদিকের নির্দেশে কাজ করেছেন সংবাদপত্রে, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন, পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে ঢাকা প্রকাশ বা সমকালের মতো ঐতিহ্যবাহী সাময়িকপত্রের মাধ্যমে সাহিত্যে যাঁর অভিষেক, মাদ্রাসার শিক্ষকতা দিয়ে যার কর্মজীবনের সূচনা, মেহনতী ও দলিত মানুষের পক্ষে রাজনীতি করার দায়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের ইতি ঘটিয়েছিল, ষাটের দশকে সরকারের সংগ্রহশালার জন্য আজকের দেশসেরা বাঙালী শিল্পীদের শিল্পকর্ম কেনার কারণে দুর্নীতি দমন বিভাগ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এবং পরবর্তীকালে যিনি বাংলাদেশ সরকারের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতা ও সৃজনশীলতার সঙ্গেÑ এমন একজন সংগ্রামশীল মানুষ আমাদের সমাজে খুব বেশি আছেন কি? আমি সুলেখক গবেষক মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের কথা বলছি। সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। সুদীর্ঘকাল সরকারী চাকরি করার পর অবসরে যান আমলারা, শতকরা নিরানব্বই দশমিক নয় নয় জনের হাত থেকেই কোন অভিজ্ঞতালব্ধ পুস্তক বেরোয় না। সেদিক দিয়ে তিনি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। না, আমি কেবল সামাজিক-রাষ্ট্রিক বা আত্মজৈবনিক রচনার কথা বলছি না। বলছি, পেশাগত দক্ষতা-অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ গ্রন্থের কথা। ইতিহাস, মুদ্রাতত্ত্ব, প্রতœতত্ত্ব, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, কুটিরশিল্প ও কারুশিল্পÑ প্রভৃতি বিষয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা বারো। সমকালীন বিষয়ে পত্রপত্রিকায় তার লেখা কলাম যারা পড়েছেন তারা তার নিয়মিত পাঠকে পরিণত হয়েছেন বলেই আমার ধারণা। কেননা তার রচনায় থাকে প্রসাদগুণ এবং সোজাসাপ্টা বক্তব্য। কারুশিল্প বিষয়ে তিনি রীতিমতো একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি ছিলেন বিশ্ব কারুশিল্প পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন পরিচালনা বোর্ড এবং বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বঙ্গীয় শিল্পকলা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের একজন ট্রাস্টি। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলেই তিনি ‘প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘ইনস্টিটিউশনাল সাপোর্ট ফর প্ল্যানিং এ্যান্ড প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক দুটি বই জাতিকে উপহার দিয়েছেন। এ ছাড়াও আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি গবেষণাগ্রন্থ ‘ফাউন্ড অব সাম নিউ কয়েনস ফ্রম নওয়াবগঞ্জ।’ তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বোধকরি ‘লিরিকস ইন টেরাকোটা এ্যাট কান্তাজির মন্দির’ এবং ‘লিভিং ক্রাফটস ইন বাংলাদেশ।’ বাংলায় এ ধরনের গ্রন্থ দুষ্প্রাপ্য নয়, কিন্তু ইংরেজীতে কয়খানা বই আছে? আমাদের ঐতিহ্যের ঐশ্বর্যগুলো বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনে ইংরেজীতে লেখার কোন বিকল্প নেই। মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ দেশপ্রেমিক ব্যক্তি বলেই শ্রম স্বীকার করে এই দুটি স্থায়ী কাজ করেছেন। অথচ কী এক অজ্ঞাত কারণে যথাযোগ্য প্রচার ও মূল্যায়ন তার ভাগ্যে জোটেনি। হতে পারে আমলাদের প্রতি আমাদের ‘বুদ্ধিজীবী’ সমাজের ছক-বাঁধা কিছু ধারণাই এ জন্য দায়ী। পাণ্ডিত্যে যেন কেবল তাদেরই একক অধিকার! মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের সর্বশেষ গ্রন্থ সময়ের বয়ান পড়তে পড়তে আমাদের সামনে ইতিহাসের একেকটি পর্দা সরে যেতে থাকে। ব্যক্তির জীবন কীভাবে বদলে যেতে যেতে বৃহত্তর মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে এসে মেশে, কীভাবে একটি নির্দিষ্ট কালপর্বে একটি নির্দিষ্ট ভূখ-ে শত হাজার মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত থেকে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে- তার একটি গাল্পিক দীর্ঘ কথন আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। সময়ের বয়ান এক অর্থে যাপিত জীবনেরই বিবরণ, ব্যক্তি বিশেষেরই কাহিনী। আত্মজৈবনিক রচনাসম্ভার হলেও কখনও কখনও দর্শকের অবস্থান থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণের আঙ্গিক অনুসৃত হওয়ার ফলে তা হয়ে উঠেছে অপর ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের জীবনীখ-। তাতে তথ্যের সমাবেশ যেমন ঘটেছে, তেমনি বিস্মিত হয়েছে জীবনদর্শন। সব মিলিয়ে কৌতূহল জাগানিয়া, স্বাদু তো বটেই। সরসতার সৌগন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে ছত্রে ছত্রে। বন্ধুদের স্থান দিয়েছেন লেখক যথাযোগ্য উচ্চতায়, তাদের নানামুখী অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। সাধারণত কোন লেখক যখন আপন কথা লেখেন তখন এমন বিষয় বা বক্তব্য এড়িয়ে যান যা তাকে সামান্যতম হলেও অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। কিন্তু সত্যসন্ধানী এবং পরমতসহিষ্ণু মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের কাছে এ ধরনের ‘অবাঞ্ছিত’ উপাদানও উপভোগ্য এবং প্রকাশের যোগ্য। পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে সময়ের সারসত্য অক্ষর ধারায় বয়নের জন্য সময়ের সারথী হওয়ার দরকার পড়ে না, বয়ানকারীকে হতে হয় নির্মোহ, জিজ্ঞাসু, সৎ ও সত্যবান। কারও প্রতি বিশেষ পক্ষপাত কিংবা কারো প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ পোষণ করে সময়ের প্রকৃত কণ্ঠস্বর হওয়া যায় না। মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন সময়ের বয়ান গ্রন্থে সময়কে যতটুকু পরিসর ও পরিধির ভেতরেই ধরার চেষ্টা করুন না কেন, তার উদ্যোগ, দৃষ্টিভঙ্গি ও লেখনীশৈলী প্রশংসাযোগ্য। এই বই ইতিহাসপ্রেমীদের জন্যও প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হবে বলে মনে করি। যারা মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন নামের এক গুণীজন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তাদের জন্য এই একটি গ্রন্থই যথেষ্ট। সে জন্যই এই বই নিয়ে এত কথা বলা। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ [email protected]
×