ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুর আধো আধো বোলে শহীদ মিনারে উচ্চারিত শ্রদ্ধা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শিশুর আধো আধো বোলে শহীদ মিনারে উচ্চারিত শ্রদ্ধা

আরাফাত মুন্না ॥ তৃণয় রায়। বয়স ১০ বছর। মাথার ওপরে হাতে লেখা প্লাকার্ড ‘শুদ্ধ বাংলা বলুন’। মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়। মাথায় এই সেøাগান লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন, জানতে চাইলে তৃণয়ের উত্তর শহীদদের সম্মান জানাতে। ছেলেটি এখনও প্রাথমিকের গ-ি পেরোয়নি, তারপরও ভাষার জন্য কত টান। তৃণয় বলেন, ভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের সম্মান করতে সবাইকেই শুদ্ধভাবে কথা বলতে হবে। তৃণয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সে রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। প্রতি বছরই শহীদ মিনারে আসে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। তৃণয় এবার চাচা শংকর কুমার রায়ের সঙ্গে এসেছে। শংকর জনকণ্ঠকে জানালেন ভোরেই এসেছেন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। নিজেদের সঙ্গে শিশুদের কেন শহীদ মিনারে নিয়ে আসেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যে ভাষায় কথা বলছি তা এমনি পাইনি। এ ভাষার জন্য সালাম, বরকতরা বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছেন। বাচ্চাদের মনে সেসব ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতেই ওদের নিয়ে আসি। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তৃণয়ের মতো অনেক শিশুই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শহীদ মিনারে এসেছিল ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। শিশুদের শহীদ মিনারে নিয়ে আসার কারণ হিসেবে সব অভিভাবকরাই কণ্ঠ মিলিয়েছেন শংকর কুমার রায়ের সঙ্গে। অভিভাবকরা মনে করেন, শিশুদের যদি আমাদের জাতীয় রীতি-নীতির প্রতি আকৃষ্ট করা যায় তাহলে ওরা জঙ্গীবাদে জড়াবে না। শিশুকাল থেকেই আমাদের মাতৃভাষা প্রাপ্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস ওদের মনে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাহলে জঙ্গী সংগঠনগুলো ওদের মনে কোন ভ্রান্ত ধারণা ঢুকতে পারবে না। তৃণয়ের মতো মাহিয়াও ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে শহীদ মিনারে। সূর্য ওঠার আগেই সাড়ে তিন বছর বয়সী মাহিয়া বাবার হাত ধরে এসেছে পলাশী মোড়ে। উদ্দেশ্য শহীদ মিনারে ফুল দেয়া। মাহিয়াদের বাসা রাজধানীর শেওড়া পাড়ায়। ওখান থেকেই ফুল ও জাতীয় পতাকা কিনেছে সে। মাহিয়ার বাবার মাহামুদুল হাসান বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে শিশুদেরও আগ্রহটা অনেক বেশি। আমার মেয়ে রাতেই শহীদ মিনার যাবে এমন জেদ করে আমাকে বাসা থেকে বের করেছে। তবে তাকে পতাকা আর ফুল কিনে দেয়া শেষে বুঝিয়ে বলেছি যে সকালেই আমরা শহীদ মিনারে যাব। ছোট ছোট কণ্ঠে শিশু মাহিয়া জানায়, ফুল, পতাকা কিনেছি, শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসেছি। শাহবাগের ওষুধ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন এসেছেন তার প্রায় দুই বছরের ছেলে হোসাইন মোহাম্মদ তাহরীমকে নিয়ে। তাহরীম বাবার মোটরসাইকেলে চুপচাপ বসা। সকাল সাতটার দিকে টিএসটি মোড়ে কথা হয় আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। এত ছোট সন্তানকে নিয়ে শহীদ মিনারে আসার কারণ কি, জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, আসলে আমি যখন ছোট ছিলাম আমার বাবাও আমাকে আমাদের গ্রামের স্কুলের শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেন। বাবার কাছ থেকেই শিখেছি শহীদের সম্মান জানানো। এখন আমিও বাবা হিসেবে আমার সন্তানকে শেখাচ্ছি। তিনি বলেন, ওর বয়স এখনও দুই বছর হয়নি। এখন হয়ত খুব বেশি বুঝবে না। তবে আমি মনে করি এখানে এসে ওর মনের মধ্যে অটোমেটিকভাবেই ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হবে। পাঁচ বছর বয়সী আফরা সাইয়ারা শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে চিকিৎসক বাবা নজরুল ইসলামের সঙ্গে। এত সকালে কেন এখানে এসেছ, এ প্রশ্নের উত্তরে আফরা জানায়, শহীদ মিনারে ফুল দিতে। আফরার বাবা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বাঙালী জাতির জন্য একটি বিশেষ দিন। এই দিনেই মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাওয়ার জন্য অনেক শহিদ বুকের তাজা রক্ত ঝারিয়েছেন। তাদের সম্মান জানাতেই মেয়েকে নিয়ে এসেছি। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি সকল শিশুকেই অন্তত জাতীয় দিবসগুলোতে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাহলে ওরা আমাদের জাতীয় রীতিনীতি শিখবে। আমাদেরে জাতীয় দিবসগুলো কেন কিভাবে এসেছে, ওদের মনে সেটা জানার আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
×