ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তরুণ হকারদের নিয়ে জেএমবি তৈরি করছে ডাকাত দল

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

তরুণ হকারদের নিয়ে জেএমবি তৈরি করছে ডাকাত দল

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জেএমবির টার্গেট তরুণ হকাররা। তাদের নানা কৌশলে দলে ভেড়াচ্ছে। তাদের দিয়ে গঠন করছে ছিনতাইকারী চক্র ও ডাকাত দল। এসব দলই দেশের বিভিন্ন জেলায় মোটা অঙ্কের টাকা ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। দলীয় ফান্ড মোটাতাজা করার পাশাপাশি নিজেদের খরচ চালাতে এমন কৌশল নিয়েছে জঙ্গী সংগঠনটি। দেশের বিভিন্ন জেলায় জেএমবির এ ধরনের অনেক দল রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে এর সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তারা বিভিন্ন জেলায় ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে ছিনতাই ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করছে। এক জেলার জেএমবি সদস্যরা আরেক জেলায় গিয়ে অপরাধ সংঘটিত করায় তাদের সহজে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ একজনসহ জেএমবির চার সদস্য পুলিশের কাছে হাতেনাতে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি নরসিংদী জেলায় ছয়টি বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পাঁচটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে জেলা সদরে। একটি জেলা সদরের পার্শ্ববর্তী একটি উপজেলায় ঘটে। প্রতিটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত আটটার মধ্যে। কাকতালীয়ভাবে সম্প্রতি ৪২ জন দুর্ধর্ষ ডাকাত জামিনে কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত ডাকাতদের মধ্যে যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কম মামলা রয়েছে, সেও পাঁচটি দুর্ধর্ষ ডাকাতির মামলার আসামি। সঙ্গত কারণেই সংঘটিত ডাকাতির ঘটনাগুলো জামিনপ্রাপ্ত পেশাদার ডাকাতরাই করেছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা ছিল। কিন্তু জেলা সদরের একটি বাড়িতে ষষ্ঠ নম্বর ডাকাতি করার সময় হাতেনাতে চার ডাকাত গ্রেফতার হয়। এদের মধ্যে একজন যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ। পরে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ডাকাতি করা টাকার মধ্যে নগদ ৪৩ লাখ টাকা আর ৬৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসতে থাকে পিলে চমকানোর মতো তথ্য। দায়িত্বশীল একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃতরা সহজে মুখ খুলছিল না, যা রীতিমতো সন্দেহের সৃষ্টি করে। কারণ ডাকাতদের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাদের ডাকাতির বিষয়টি স্বীকার করার প্রবণতা বেশি। কিন্তু এ চারজন কোনক্রমেই মুখ খুলছিল না। তাদের মানসিকসহ নানাভাবে মোটিভেশন করা হয়। শেষ পর্যন্ত তারা ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বলে। তাদের প্রায় সবার বাড়িই গাজীপুর ও ঢাকায়। তারা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে তারা ক্ষীরা, বাদাম, আমড়া, গাঁজরসহ অন্যান্য খাবার ও জিনিসপত্র বিক্রি করত। তারা মূলত হকার। তারা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিনই এসব বিক্রি করত। একদিন তাদের কাছে একজন আসে। তাদের বয়স হকারদের বয়সের সমান। তারা এসে হকাররা যেসব খাবার ও জিনিসপত্র বিক্রি করত, সেসব খেত বা কিনে নিত। কেনার ফাঁকে ফাঁকে হকারি করে দিনে কত টাকা রোজগার হয়, বাড়িতে কে কে আছে, এসবের খোঁজখবর নিত। এভাবে ৩-৪ দিন তারা ওই হকারের সঙ্গে কথা বলে। খাতির জমে গেলে তারা হকারদের আরও বেশি টাকা রোজগারের কথা জানায়। এরপর তারা টার্গেটকৃত হকারদের তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদের প্রথমে ধর্মের দোহাই দিয়ে মগজধোলাই করা হয়। কয়েকদিন মগজধোলাই করার পর তাদের আল্লাহর পথে কাজ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। যে কয় দিন আস্তানায় থাকে, সে কয়দিন সংসারের খরচ চালানোর অর্থ জেএমবির তরফ থেকে দেয়া হয়। আল্লাহর পথে কাজ করার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পর তাদের প্রথমে ধর্মীয় কাজে যুক্ত করা হয়। এরপর তাদের দল চালাতে অর্থ যোগাড় করার প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো হয়। ধর্মের জন্য অর্থ যোগাড় করতে তাদের যে কোন ধরনের কাজ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এর পরই পর্যায়ক্রমে তাদের দিয়ে গঠন করা হয় ছিনতাইকারী গ্রুপ ও ডাকাত দল। ছিনতাইকারী গ্রুপ গঠন করা হয় সর্বোচ্চ পাঁচজনের সমন্বয়ে আর ডাকাত দল গঠন করা হয় সাত থেকে দশজনের সমন্বয়ে। তবে টার্গেট বিবেচনায় রেখে অনেক সময় গ্রুপে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো- কমানো হয়। পরবর্তীতে এসব ছিনতাইকারী গ্রুপ ও ডাকাত দলকে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। তারা টার্গেটকৃত জেলায় গিয়ে বেনামে বাড়ি ভাড়া করে। তাদের এসব কাজে সহায়তা করে ওই সব জেলায় থাকা জেএমবি সদস্যরা। এরপর সুযোগ বুঝে মোটা অঙ্কের টাকা ছিনতাই বা ডাকাতি করে সেখান থেকে পালিয়ে অন্য জেলায় আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে সাধারণত তারা ঘটনাস্থলের পাশের জেলায় আশ্রয় নিয়ে থাকে। তবে মূল কলকাঠি নাড়া হয় আরও দূরের কোন জেলা থেকে। যে চারজন গ্রেফতার হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জেএমবির একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের একজন যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ। সে জেএমবির দলীয় নির্দেশে ছিনতাই করার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। পরে তাকে আদালত কারাগারে পাঠায়। কারাগারে থাকার সময় মুজাহিদের নানা ব্যক্তিগত কাজের ফরমায়েশ করার দায়িত্ব পেয়েছিল সে। প্রসঙ্গত, ওই সময় মুজাহিদ সাবেক মন্ত্রী হিসেবে কারাগারে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী হিসেবে বিবেচিত হতো। ফাঁসির দ- পাওয়ার পর তার ডিভিশন বাতিল হয়ে যায়। পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, মুজাহিদের সংস্পর্শে যাওয়ার পর সে জামিনে ছাড়া পায়। ওই ছিনতাইকারীর জামিনের বিষয়ে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সহযোগিতা করেছিল। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আবার সে জেএমবির কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, ছিনতাই বা ডাকাতি দলের সদস্য সংখ্যার চেয়ে ছিনতাইকৃত বা ডাকাতি করা মালামালের দুটি ভাগ বেশি হতো। অর্থাৎ ছিনতাইকারী বা ডাকাত দলে সদস্য সংখ্যা পাঁচজন হলে ছিনতাইকৃত মালামাল ভাগ হতো সাতটি। প্রত্যেক সদস্যকে এক ভাগ করে দেয়া হতো আর বাকি দুই ভাগের মধ্যে একভাগ দলের ফান্ডে জমা দেয়া হতো। আরেক ভাগ দলের সদস্যদের কল্যাণ ফান্ডে জমা দেয়া হতো। কল্যাণ ফান্ডের টাকা দিয়ে কোন সদস্য গ্রেফতার হলে বা কোন সদস্যের পরিবার বিপদগ্রস্ত হলে সহায়তা করা হতো। তবে কল্যাণ ফান্ডের টাকা সাধারণত দলের গ্রেফতারকৃত সদস্যদের জামিনের জন্য ব্যয় করা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে নরসিংদী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসিবুর রহমান জানান, নরসিংদীতে ছয়টি দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ষষ্ঠ নম্বর ডাকাতির সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হয় চার ডাকাত। গ্রেফতারকৃত ডাকাতরা জেএমবির সদস্য। তাদের কাছ থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডাকাতির সময় জেএমবি সদস্যরা সাধারণত নিতান্তই নিরুপায় না হলে কাউকে মারধর করে না। হাত-পা বেঁধে শুধু নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয়। বিভিন্ন জেলায় জেএমবির ছিনতাইকারী গ্রুপ ও ডাকাত দলের তৎপরতা রয়েছে। জেএমবি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের জন্য যাদের দলে ভেড়ায়, তাদের তারা দলের লেবার বলে থাকে। তাদের মূল টার্গেট তরুণ হকাররা। এক জেলার সদস্যরা আরেক জেলায় গিয়ে ছিনতাই ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করে। অপরাধ সংঘটিত করার পর তারা অন্য জেলায় আত্মগোপনে চলে যায়। ফলে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। চক্রটির একজন দলনেতার সন্ধান পাওয়া গেছে। সে জেএমবির শীর্ষপর্যায়ের নেতা। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। ওই নেতার বাড়ি জামালপুরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই জেএমবি এমন কর্মকা-ে জড়িত। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল দুপুরে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের কাঠগড়া বাজার শাখায় বোমা মেরে, গুলি চালিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, নিরাপত্তারক্ষীসহ তিনজনকে হত্যা করে ক্যাশ লুট করে জঙ্গীরা। স্থানীয়দের সঙ্গে ডাকাতদের ধাওয়া ও গুলির ঘটনা ঘটলে আরও চারজনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষপর্যায়ের নেতা মাহফুজুল ইসলাম শামীম ওরফে সুমন গ্রেফতার হয়। সুমন মূলত জেএমবির সদস্য। পরবর্তীতে সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেয়। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ গাজীপুরের বোর্ডবাজারে একজনকে গুলি করে হত্যার পর বিকাশের পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় জেএমবির একটি ছিনতাইকারী গ্রুপ। এ ঘটনায় জড়িত ছিল সাভারের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতারকৃত শামীম। এছাড়া ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাজধানীর তেজগাঁও থেকে জেএমবির সাত সদসকে বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত স্বর্ণালঙ্কার, নগদ প্রায় সাত লাখ টাকা, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। উদ্ধারকৃত মালামাল গ্রেফতারকৃতরা নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্ত করার ব্যয় মেটাতে এবং দলীয় ফান্ডে অর্থ জমা করতে দীর্ঘদিন ধরেই ডাকাতি ও ছিনতাই করে জমিয়েছিল বলে স্বীকার করে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ১৯৯৮ সালে জেএমবি গঠনের পর বিভিন্ন সময়ে জেএমবি সদস্যরা ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত হয়েছে। তাদের নেতা কারাবন্দী মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে ডাকাতিকে বৈধতা দিয়ে গেছেন। এছাড়া জেএমবি প্রধান সাইদুর রহমান গ্রেফতারের পর তার ছেলে বাশার দলের হাল ধরার পর দলীয় ফান্ড গঠনের জন্য দলের সদস্যরা বেশি হারে ডাকাতি ও ছিনতাই শুরু করে। পাশাপাশি জেএমবির মতে, কথিত পীরদের হত্যা করে তাদের বাসা-বাড়ি থেকে গনিমতের মাল হিসেবে টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয়া বৈধ বলে মনে করে। এমন বিশ্বাসের সূত্র ধরেই ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারী থানার রামকৃষ্ণ (আর কে) মিশন রোডে কথিত ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি ও বিশ্ব ত্রাণকর্তা দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জনকে হত্যা করে বাসা থেকে টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট, ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানার পূর্ব রাজাবাজারে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের শান্তির পথে ও কাফেলা নামক ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যা করে বাসা থেকে টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট এবং ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর রাত পৌনে ৮টায় বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা খিজির খানকে রাজধানীর মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকার নিজ বাড়িতে গলা কেটে হত্যার পর স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা, ল্যাপটপসহ সহজে বহনযোগ্য দামী মালামাল লুটে নেয়। পরবর্তীতে হত্যাকারী জেএমবি সদস্য তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক ওরফে মিঠু (২৬) দলীয় ফান্ড যোগাড় করতেই এবং দলের নির্দেশে হত্যাকা-টি ঘটায় বলে স্বীকার করে।
×