ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকের ছোবলে মানসিক রোগ বাড়ছে তরুণ সমাজে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

মাদকের ছোবলে মানসিক রোগ বাড়ছে তরুণ সমাজে

সমুদ্র হক ॥ কৃষি উন্নয়নের অগ্রগতির ধারায় মাঠ পর্যায়ের অর্থনীতির গতি বেড়ে যাওয়ায় দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণ এখনও সহনীয় পর্যায়ে না আসায় এবং নানা কারণে বিষণœতা ও অবসাদের মাত্রা বেড়েছে। ফলে ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে বিরাজ করছে অজানা এক অস্থিরতা। সামাজিক বন্ধন শিথিল হওয়াই এর অন্যতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক জরিপে বলা হয়েছে মোট জনগোষ্ঠীর অন্তত ৩০ শতাংশ জীবনের কোন না সময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। দেশে বর্তমানে মানসিক রোগীর সংখ্যা কত তা নিরূপণে সঠিক কোন জরিপ নেই। বলা হয় মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ মানসিক ভারসাম্যহীনতার মধ্যে আছে। যার সাড়ে ৪ শতাংশ তীব্র। সারাদেশে মানসিক রোগীদের জন্য কয়েকটি হাসপাতাল ও কেন্দ্রীয় মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে শয্যা সংখ্যা রয়েছে প্রায় এক হাজার। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় যেমন কম, তেমনই স্বাস্থ্যের এই খাতে বরাদ্দ কম। একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় : মাদকাসক্ত রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার নামে দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে এবং কোন কোন উপজেলায় এক ধরনের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এই ধরনের সেবা কেন্দ্রে কোন বিশেষায়িত চিকিৎসক নেই। বেশিরভাগ কথিত ডাক্তার মনগড়া চিকিৎসা দেয়। মাদকাসক্ত কোন রোগীকে সেখানে ভর্তি করার পর কথিত প্রতিটি ধাপেই যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা সাধারণের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। তারপরও বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে না। এই কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই প্রতারণার ফাঁদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের সামনে এইসব কথিত মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র চলছে। দেশে মানসিক রোগ নিরাময়ের একমাত্র বিশেষায়িত পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৪৫০। এ ছাড়াও প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগীদের জন্য দশটি করে বেড নির্ধারিত আছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেডের সংখ্যা ৪০। সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে বিশটি। কেন্দ্রীয় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ৪০। হালে কয়েকটি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। খোঁজখবর করে জানা যায়, বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতাল পাবনার অবস্থা খুব ভাল নয়। এই হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কয়েকটি শূন্য পদ এখনও পূরণ হয়নি। অব্যবস্থার কারণে অনেক চিকিৎসক সেখানে যোগদান করার পরও অন্যত্র চলে যান। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের কোয়ার্টার সংস্কারের অভাবে সুষ্ঠুভাবে বাসের অযোগ্য হয়ে আছে। একটা সময় গ্রামের অর্থনীতির চাকা সচল না থাকায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপে ব্যক্তির স্বাভাবিক আচরণে বিচ্যুতি ঘটত। বর্তমানে এই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কৃষির অগ্রগতিতে গ্রামের সিংহভাগ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি নগরায়ন ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হওয়ায় বর্তমানের এক শ্রেণীর তরুণের মধ্যে মাদকাসক্তি বেড়ে গেছে। এই ধারা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক রোগ। সমাজবিজ্ঞানীগণ বলছেন সামাজিক বন্ধন এই অবস্থার উত্তরণে সবচেয়ে বড় সহায়ক। ওষুধ দিয়ে সব সময় বিষণœতা অবসাদ ও উদ্যমহীনতার চিকিৎসা সম্ভব নয়। কাউকে ‘পাগল’ বলার আগে একটিবার ভেবে দেখা দরকার তার উৎস কোথায়। উৎসেই সামজিক চিকিৎসা আগে দরকার। একজন মনোবিজ্ঞানী জানিয়েছেন, বিষণœতা, অবসাদ, হতাশা ও অস্থিরতা থেকে সৃষ্ট মানসিক ডিপ্রেশনের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা হলো ‘কাউন্সিলিং’। আত্মীয়স্বজন এবং কাছের প্রকৃত বন্ধুরাই পারে কারও মানসিক অবসাদ ও উদ্যমহীনতা কমিয়ে আনতে। কাউন্সিলিং মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম চিকিৎসা। তার মতে, কেবলমাত্র ওষুধ সেবন মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। ওষুধ কেবল সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ সামস্ উল আলম বলেন, যে কোনভাবেই কেউ মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। মানসিক রোগীর সামনে ‘পাগল’ বা আলাপচারিতায় ‘পাগল’ বলা অনুচিত। কোন কিছু না জেনে না বুঝে ছোট্ট এই কথাটি বলায় এক সময় মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে তীব্র মানসিক ব্যাধির দিকে টেনে নিয়ে যায়। পরে তার সুচিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে।
×