ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবর্তন হচ্ছে পরিচালন ব্যবস্থায়, পূর্ণতা আসবে ছয় মাসে ;###;পরিচালক সামীম আফজালের তথ্য ;###;আমিরের স্বাক্ষরে শিবির কর্মীদের নিয়োগ হতো

চাকরি ও ঋণ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

চাকরি ও ঋণ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘জঙ্গীবাদ ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকে শিবির কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। আর এসব নিয়োগপত্রে জামায়াতের আমির স্বাক্ষর করেছেন। ইসলামী ব্যাংককে জামায়াত ও জঙ্গীবাদ মুক্ত করার এ চেষ্টা সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করে বক্তারা বলেন, ইসলামী ব্যাংকে জনগণের আমানত ৭৫ হাজার কোটি টাকার ৪ শতাংশ যেত জামায়াতের হাতে এসএমই ঋণ হিসাবে। সেটা চিহ্নিত করা হয়েছে। বক্তারা আরও বলেন, ইসলামী ব্যাংক মানুষকে সুদের বদলে মুনাফা শব্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। আরবী শব্দের ব্যবহার করে দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ব্যবসা চালাচ্ছে। শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে রিজিওনাল এ্যান্টি টেরোরিস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (রাত্রি) এ বৈঠকের আয়োজন করে। এতে অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, ড. হাফিজুর রহমান কার্জন, ড. জিনাত হুদা, অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান, অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সামীম মোঃ আফজাল প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে আগে মূলত শিবির নেতাকর্মীরা চাকরি করতেন। জামায়াত সারা দেশে দুষ্ট অর্থচক্র গড়ে তুলেছে। শুধু ব্যাংক নয়, জামায়াত বীমা ও ইন্স্যুরেন্স খাতেও আর্থিক প্রভাব বিস্তার করেছে’। ইসলামী ব্যাংক থেকে জামায়াত ও জঙ্গীবাদ মুক্ত করার এ চেষ্টা চালানোর জন্য সরকারকে তিনি ধন্যবাদ জানান। তবে ইসলামী ব্যাংক সংস্কার করে সরকার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াতের অর্থায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক থেকে জামায়াত কোটি কোটি টাকা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। ইসলামী ব্যাংক সংস্কার হলে কিছুটা হলেও জামায়াত-শিবির দুর্বল হবে। জামায়াতমুক্ত করতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির নবনিযুক্ত পরিচালক ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেছেন, আমরা কারও চাকরিতে হাত দেব না। শুধু বলব, মিটিং-মিছিল করতে যাবেন না। আর এসএমই ঋণ হিসাবে ব্যাংক থেকে যে টাকা জামায়াতের হাতে যেত, এখন আর একটি টাকাও তাদের হাতে যাবে না। সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তন এসেছে। অনেকের মধ্যে পরিবর্তনও হয়েছে। ৬ মাসের মধ্যে এটা একেবারে পরিবর্তন হয়ে যাবে। আশা করি, ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা জামায়াতের মিছিল-মিটিংয়ে যাবেন না। একইসঙ্গে মওদুদী দর্শনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হবে। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ১৭-১৮ জন পরিচালকের মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচালক আছেন ৭-৮ জন। বাংলাদেশে আরও যে ৫৫টা ব্যাংক আছে, কোনটাতেই এত বেশি স্বতন্ত্র পরিচালক নেই। যে কারণে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অনেক শক্তিশালী। নতুন এ পরিচালক সাফ বলে দেন, ইসলামী ব্যাংকে জনগণের আমানত ৭৫ হাজার কোটি টাকার ৪ শতাংশ যেত জামায়াতের হাতে এসএমই ঋণ হিসাবে। আমরা সেটা চিহ্নিত করেছি। আর একটি টাকাও জামায়াতের হাতে যাবে না। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে অর্থবহ সংস্কার আনতে হবে। কোন আপোস করলে চলবে না। তিনি বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে মৌলবাদের উত্থান করেছেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ও জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটানো হয়। কাজেই সংস্কার সব খাতেই করতে হবে। আর ব্যাংকিং খাতের সংস্কারটাও অর্থবহ হতে হবে। কোন আপোস করলে চলবে না। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেছেন, এ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় যে পরিবর্তন হয়েছে তা অবশ্যই ভাল। এতে জামায়াতের আর্থিক জোগান কমে যাবে। তবে জামায়াতের ঘাপটি মেরে থাকা অংশ পরবর্তীতে রূপ বদল করে নতুন কোন রূপে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সেজন্য আমাদের সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমে বাংলা ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমে বাংলা ব্যবহার হচ্ছে না। সঞ্চয়ী হিসাব, প্রাথমিক হিসাব, সুদ ইত্যাদি বোঝাতে আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়। আরবীর বদলে বাংলা ব্যবহার করতে হবে। ড. মীজানুর রহমান বলেন, ইসলামী ব্যাংক মানুষকে সুদের বদলে মুনাফা শব্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। আরবী শব্দের ব্যবহার করে দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ব্যবসা চালাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে কস্ট অব ক্যাপিটাল কমকে চিহ্নিত করেন জবি উপাচার্য। তিনি বলেন, অনেকেই সুদ নেবেন না বলে সেখানে অর্থ রাখছেন। সেখান থেকে ক্যাপিটাল বাড়ে। ড. মীজানুর রহমান মনে করেন, শুধু ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করেই জঙ্গীবাদের সংস্কার হবে না। তবে জামায়াতকে হয়তো চাপে ফেলা যাবে। সবদিকে কাজ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান কার্জন বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের কসমেটিক পরিবর্তন আনলে হবে না। মূলে পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য নারীসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকও নিয়োগ দিতে হবে ব্যাংকে। ড. রহমান বলেন, ইসলামী ব্যাংকে ৮০ হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে। আমানতকারীর আস্থা ব্যাংক অর্জন করতে পেরেছে। এটা অটুট রাখতে হবে। এছাড়া করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর কর্মসূচী বাড়াতে হবে। শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ ও সামাজিক খাতে অনুদান বাড়াতে হবে। তাই কসমেটিক পরিবর্তন আনলে হবে না। সমুলে পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইসলামী ব্যাংকে অন্য ধর্মের কোন নারী নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান বা অন্য ধর্মের লোকবল নেই। কাজেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রগতিশীল যে আন্দোলন ছিল, ৭৫ এর পর সেটা ধ্বংস হয়ে গেছে। এটাও পুনরুদ্ধার করতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে জামায়াতের কাছে কোটি কোটি টাকা আসছে বলে জানিয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘জামাতের কাছে কোটি কোটি টাকা আসলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শক্তভাবে ধরেছেন। তবে জামায়াত বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের গুটিকয়েক জন সেভাবে সহায়তা করছেন না। প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সম্ভব নয় জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়ার। আমাদের সবার উচিত প্রধানমন্ত্রীকে সহায়তা করা।’ জামায়াত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জামায়াত শেষ হয়নি। প্রতিটা গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে আছে। এখনও মওদুদীবাদের বই বিতরণ করা হয়। এগুলো ধরে কেন ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে না। জামায়াতকে রুখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর গাঁটছাড়া প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন এনে জঙ্গী অর্থায়নে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। জঙ্গী অর্থায়নের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীসহ অন্যদের ফাঁসি দেয়ার মাধ্যমে জামায়াতের নখদন্ত ভোঁতা করে দেয়া হয়েছে। তবে তাদের অর্থ সাম্রাজ্য এখনও অটুট। রাজধানীসহ সারাদেশেই তাদের বিভিন্ন ভবন দৃশ্যমান। এসবের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপি আমলের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান জাতীয় সংসদে বলেছিলেন- ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে জঙ্গীবাদের অর্থায়নের যোগসূত্র আছে। আমরাও অনেক আগে থেকে বলে এসেছি। এখনও ব্যাংকের ৯০ শতাংশ কর্মী জামায়াত-শিবিরের।
×