ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

সঞ্জীব বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সঞ্জীব বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে

নেশা, পেশা ও ভালবাসা যখন একটি বিন্দুতে মিলিত হয় তখন তার জন্য যে পেশার শীর্ষে একটি আসন নির্ধারিত হয়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সঞ্জীব চৌধুরী। গত কিছুদিন আগে- পরেই চলে গেল তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। মানুষ মরণশীল। পৃথিবীতে যত মানুষ আসে, সবাই চলে যায়। চলে যাওয়া কিংবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আমরা সবাই তাকে ভুলে যায়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটে যখন মানুষটি হয় কীর্তিমান। গুণীজনরা বলেন ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’। মানুষের মনে অপার ভালবাসা যিনি রেখে যান, কিংবা মানুষের জন্য কিছু করে যান। তাকেই মানুষ মনে রাখে যুগের পর যুগ। তিনি মানুষের মাঝে থাকেন এবং নানা প্রসঙ্গে ঘুরে ফিরে আসে আমাদের মাঝে। সঞ্জীব চৌধুরীও এমনি একজন কীর্তিমান। তাই তো তাকে এবং তার হাতে গড়া ব্যান্ড ‘দলছুট’ কে আজও মানুষ মনে রেখেছে। একজন সৃজনশীল মানুষ বলতে যা বোঝায় সঞ্জীব চৌধুরী ঠিক তাই ছিলেন। তিনি জীবনে যখন যা করেছেন ভালবেসে করেছেন মনযোগের সঙ্গে করেছেন। প্রত্যেকটা কাজে তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। শিক্ষা জীবনেও তার ব্যতিক্রম ছিল না মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। তারপর ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে এবং সেখান থেকেই অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে অর্থাৎ ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সংগঠনটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নে তিনি গড়ে তোলেন শক্তিশালী সাংস্কৃতিক টিম।এমনকি ১৯৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি স্বৈরাচারবিরোধী অনেক লেখালেখিও করেন। তার এই স্বৈরাচারবিরোধী যুদ্ধ শুধু কলমেই থেমে থাকেনি তিনি রাস্তায় রাস্তায় স্বৈরাচারবিরোধী ও গণজাগরণের গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলেন। পড়াশোনা শেষ করে আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন সঞ্জীব চৌধুরী। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। সর্বশেষ কাজ করেছিলেন যায়যায়দিনের ফিচার এডিটর হিসেবে। সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকলেও সঙ্গীতকে তিনি কখনও জীবন থেকে আলাদা করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে তিনি বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে ‘দলছুট’ নামের ব্যান্ডটি গড়েন। ‘দলছুট’ নামটি সঞ্জীব চৌধুরীরই দেয়া। ১৯৯৭ সালে, দলছুট তাদের প্রথম এ্যালবাম ‘আহ’ বের করেন। এর তিন বছর পর দ্বিতীয় এ্যালবাম বের করেন ‘হৃদয়পুর’। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। ২০০২ সালে বের হয় এ দলের তৃতীয় এ্যালবাম ‘আকাশচুরি’। বাপ্পা ও সঞ্জীবকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয় দলছুটের তাদের এ্যালবামের গানগুলো। তরুণ সমাজের মুখে মুখে শোনা যেতে লাগল তাদের জনপ্রিয় গানগুলো। ২০০৭ সালে বাপ্পা-সঞ্জীব প্রকাশ করেন দলের চতুর্থ এ্যালবাম ‘জোছনাবিহার’। এই এ্যালবামের গানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু ২০০৭ সালের ১৯ নবেম্বর সঞ্জীব মারা যান। দলছুটের জন্য তো বটেই আমাদের দেশের শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চায় এক মারাত্মক ধাক্কা। যা আজও তার অভাব আমরা অনুভব করে চলেছি। তিনি শুধু শিল্পী ছিলেন না সাংবাদিক, সুরকার, গীতিকার, কবি, অভিনেতা কি নেই তার গলায়, গানে সুরের মূর্ছনায়, অভিনয়ে আবৃত্তিতে। একজন খাঁটি সৃজনশীল সংস্কৃতিবান ব্যক্তি বলতে যা বোঝায় সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন তাই ছিলেন। গুণী এই শিল্পীর জন্মদিন ছিল গত ২৫ ডিসেম্বর। অসময়ে অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১৯ নবেম্বর মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। রেখে যান এক মেয়ে কিংবদন্তি ও স্ত্রী আলেমা নাসরীন শিল্পীকে। বর্তমানে আমাদের দেশে বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাপক। দেশীয় সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। তারপরেও সঞ্জীব চৌধুরীর গান আমাদের দেশের মানুষের মনের মাঝে আজও স্থান করে আছে থাকবে।
×