ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

ছুটির দিনে প্রাণময় আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১২ নভেম্বর ২০১৬

ছুটির দিনে প্রাণময় আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব

মনোয়ার হোসেন ॥ জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়তই অবিরাম ছুটে চলা শহর ঢাকা। চিরাচরিত সেই বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে এই শহরটা মাঝে মাঝেই হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ। বয়ে যায় সুরেলা শব্দধ্বনি। গানের সুরে সকল অবসাদ কাটিয়ে প্রাণের আনন্দে মেতে ওঠে নাগরিক মন। শুক্রবার ছুটির দিনে তেমন দৃশ্যেরই দেখা মিলল রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। লোকসঙ্গীতের মরমী বাণীতে আপ্লুত হলো শহুরে শ্রোতাকুল। সুরের সহযোগে মানবতা ও আধ্যাত্মবাদী দর্শনে প্রাণিত হলো তাদের অন্তরাত্মা। জমাট বাঁধা শ্রোতা-দর্শকে মুখরিত হলো ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের আঙ্গিনা। সন্ধ্যা পেরিয়ে সময় যখন রাতের পানে ধাবিত হয়েছে ক্রমশই বেড়েছে সুররসিকদের আনাগোনা। একপর্যায়ে লোকগানের মায়াজাল ছড়ানো বিশাল আয়োজনটি বিপুল শ্রোতার আগমনে পরিণত হয় জনারণ্যে। সবাই মিলে জোটবেঁধে উপভোগ করেছেন বাংলাদেশ, ভারত, কানাডা ও স্পেনের লোকসঙ্গীতশিল্পীদের বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। দ্বিতীয় দিনের সবগুলো পরিবেশনাই কম-বেশি আকৃষ্ট করেছে শ্রোতা-দর্শককে। তবে এদিনের অন্যতম আর্কষণ ছিল ভারতের কৈলাশ খের। সবশেষে রাত ১টার পর মঞ্চে আসেন ভারতীয় লোকসঙ্গীত ও সুফি সঙ্গীতে প্রভাবিত নিজস্ব ধারা গড়া এই শিল্পী। অনন্য কণ্ঠের মাধুর্যে গানে গানে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে রাখেন কৈলাশ। শুরুতেই গেয়ে শোনান ‘আরোজি আরোজি’। এছাড়াও গেয়ে শোনান ‘তেরি দিওয়ানি, সাইয়া, আল্লাহ কি বান্দে’র মতো নিজের তুমুল জনপ্রিয় গানগুলো। এছাড়াও এদিন বিশেষভাবে বলতে হয় স্পেনের মিউজিক্যাল গ্রুপ কারেন লুগো এ্যান্ড রিকার্ডো মোরোর পরিবেশনার কথা। দলটি উপস্থাপন করে স্পেনের উদালুসিয়া এক্সত্রেমাদুরা ও মুরসিয়া এলাকার বিশেষ ধরনের আর্ট ফর্ম। এটি ফ্লামেঙ্কো নাচ হিসেবেও পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এ পরিবেশনায় গানের সঙ্গে ছিল গিটারের বাদন, নাচ ও বিশেষ ধরনের করতালি। উৎসব উপভোগকারীদের জন্য এ দলের পরিবেশনাটি ছিল ভিন্ন আমেজের। স্প্যানিশ গিটারের সুরমূর্ছনার সঙ্গে গান এবং দুই নারী-পুরুষের নৃত্যÑ সব মিলিয়ে অনবদ্য। আর সেই মুগ্ধতায় ঘুচে যায় ভাষার দূরত্ব। তাই তো দর্শক-শ্রোতাও মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে মিশে যান পরিবেশনার সঙ্গে। নওগাঁর বাউল পরিবার থেকে উঠে আসা বাঁশরিয়া জালালের বাঁশির সুরে হেমন্ত সন্ধ্যায় শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনা। বাঁশিতে ভেসে বেড়ায় ‘আমার সোনার ময়না পাখি’ গানের সুর। বাঁশির সুরের সহযোগে নজরুলের ঢোলের বাদনে শ্রোতাদের মননে ছড়ায় উচ্ছ্বাস। এই দলে আরো ছিলেন কক্সবাজারের ক্ষুদে বাউল জাহিদ। গেয়ে শোনায় চট্টগ্রামের লোকসঙ্গীত ‘মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা’। পালাগান নিয়ে মঞ্চে আসেন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের পালাকার লতিফ সরকার। প্রেম ও বিচ্ছেদের আশ্রয়ে মেঠোসুরে গেয়ে শোনান ‘দেখতে কি সুন্দর জালালের জালালি কৈতর’, ‘আমার মন মজাইয়ারে’, ‘সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে’। সবশেষে পরিবেশন করেন ‘একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর’। লতিফ সরকারের পরিবেশনা শেষে মঞ্চে আসেন কানাডার শিল্পী প্রসাদ ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান শিল্পী তানভির আলম রাজীব। প্রসাদ গিটার, সেতার ও বাঁশিযোগে গান পরিবেশন করেন। আর রাজীব ছিলেন তবলায়। তারা ‘রাইজ লাইক এ সান’, ‘নো ওয়ার’ ও ‘রাইজ আপ দ্য পিপল’ গানগুলো ছাড়াও গিটার ও তবলার ইনস্ট্রুমেন্টাল বাজিয়ে শোনান। এরপর মঞ্চে আসে লোকগাননির্ভর ভারতের ব্যান্ডদল ইন্ডিয়ান ওশেন। সেই সুবাদে শোনা যায় শ্লোক, সুফি সঙ্গীত ও জ্যাজের সংমিশ্রণে ফিউশন মিউজিক। নিখিল রাও, অমিত কিলাম, রাহুল রাম, হিমাংশু যোশি ও তুহিন চক্রবর্তীর দলটি মাতিয়ে রাখে শ্রোতাদের। ইন্ডিয়ান ওশেনের পরিবেশনার মুগ্ধতার রেশ না কাটতেই মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের বাউল শফি ম-ল ও লাবিক কামাল গৌরব। লাবিব গেয়ে শোনান ‘পাইতাম যদি মনের মানুষ’, ‘যমুনার ঘাটে সখী’ গানগুলো। শফি ম-ল গেয়ে শোনান ‘চাতক বাঁচে কেমনে’, ‘সোনার মানুষ’, ‘মসজিদে-মন্দিরে যেতে হলো না আমার/আমি মন মন্দিরে পূজা দেব’। মূল মঞ্চের সামনে ও পেছনে, স্টেডিয়ামের ঘাস ও গ্যালারিতে এবং খাবারের জায়গাজুড়ে অবস্থানরত শ্রোতাদের আলাদাভাবে বিন্যাস করা যায়। খাওয়া, আড্ডা, সেলফি তোলা উপলক্ষ হলেও লক্ষ্য একটাই- লোকসঙ্গীতের সুরে হারিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করছে সান ইভেন্টস। মেরিল নিবেদিত উৎসবে সহযোগিতায় রয়েছে জিপি মিউজিক, ঢাকা ব্যাংক ও মাইক্রোসফট বাংলাদেশ। সমাপনী পরিবেশনা : আজ শনিবার শেষ হবে উৎসব। সমাপনী দিনে থাকবে বাংলাদেশের বারী সিদ্দিকী, সুনীল কর্মকার, ইসলাম উদ্দিন কিস্সাকার এবং তাপস ও তার বন্ধুদের পরিবেশনা। এছাড়াও থাকবে ভারতের নুরান সিস্টার্সের পরিবেশনা। উপস্থাপিত হবে যুক্তরাজ্যের স্যাম মিলস ও সুশীলা রহমানের পরিবেশনা। উপমহাদেশের কিংবদন্তি পবন দাস বাউলের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের।
×